যাদু, ভাগ্য গণনা ও দৈব কর্ম

যাদু, ভাগ্য গণনা ও দৈব কর্ম

এসব কিছুই শয়তানী কাজ-কর্ম এবং হারাম, যা আক্বীদায় ত্রুটি সৃষ্টি করে কিংবা আক্বীদা নষ্ট করে দেয়। কেননা শিরকী কাজ-কর্ম ছাড়া এগুলো অর্জন করা যায় না।

১. যাদু:

যাদু এমন এক বস্তুকে বলা হয় যার উপকরণ নিতান্ত গোপন ও সূক্ষ্ণ হয়ে থাকে। আর যাদুকে যাদু নামে এজন্য অভিহিত করা হয় যে, এটা এমন সব গোপনীয় কাজের মাধ্যমে অর্জিত হয় যা দৃষ্টির আগোচরে থাকে। যাদুর মধ্যে মন্ত্র পাঠ, ঝাড়ফুঁক, বাণী উচ্চারণ, ঔষধপত্র ও ধূম্রজাল- এসব কিছুর সমাহার থাকে। যাদুর প্রকৃত অস্তিত্ব রয়েছে। কোন যাদু মনের উপর আছর করে এবং কোনটা দেহের উপর। ফলে মানুষ কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ে, কখনো নিহতও হয় এবং এর দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা যায়। যাদুর এই আছর ও প্রতিক্রিয়া আল্লাহ তাআলার পার্থিব ও তাক্বদীরে নির্ধারিত হুকুম ও অনুমতি ক্রমেই হয়ে থাকে। আর এটা পুরোপুরি শয়তানী কাজ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যাদু -বিদ্যা আয়ত্ব করতে হলে শিরকের মাধ্যমে এবং অপবিত্র ও দুরাত্মাদের পছন্দনীয় কাজের মাধ্যমে তাদের নৈকট্য লাভের আশ্রয় নিতে হয়। এজন্যই শরীয়তে শিরকের সাথে যাদুর উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

اجْتَنِبُوا السَّبْعَ المُوبِقَاتِ قَالُوْا وَمَاهِيَ؟ قَالَ الإشْرَاكُ بِاللهِ وَالسِّحْرِ….

‘সাতটি ধ্বংসাত্মক বস্তু থেকে বেঁচে থাক, সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন সে গুলো কি? তিনি বললেন: আল্লাহর সাথে শরীক করা এবং যাদু…..'[১]
যাদু দু’ভাগে শিরকের অন্তর্ভুক্ত:
এক: এতে শয়তানদেরকে ব্যবহার করা হয়, তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা হয় এবং তাদের পছন্দনীয় কাজের মাধ্যমে তাদের নৈকট্য অর্জন করা হয়, যাতে তারা যাদুকরের কাজ আঞ্জাম দেয়। সুতরাং যাদু শয়তানদের শিখানো বস্তু। আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَلَكِنَّ الشَّيَاطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ ﴿১০২﴾سورة البقرة

‘বরং শয়তানরাই কুফুরী করেছিল, তারা মানুষকে যাদু-বিদ্যা শিক্ষা দিত'[২]
দুই: এতে গায়েবী এলেম ও তাতে আল্লাহর সাথে শরীক হবার দাবী করা হয়, যা মূলত: কুফুরী ও ভ্রষ্টতা। আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَلَقَدْ عَلِمُوا لَمَنِ اشْتَرَاهُ مَا لَهُ فِي الْآَخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ﴿১০২﴾ سورة البقرة

‘এবং তারা অবশ্যই জানে যে, যে কেউ তা খরিদ করে (অর্থাৎ যাদুর আশ্রয় নেয়) তার জন্য পরকালে কোন অংশ নেই'[৩]
আর পুরো ব্যাপারটা যেহেতু এমন, সুতরাং নি:সন্দেহে যাদু চর্চা কুফুরী ও শিরক, যা ইসলামী আক্বীদার পরিপন্থী এবং এর চর্চাকারীদের হত্যা করা ওয়াজিব, যেমন- একদল বড় বড় সাহাবী রাদি আল্লাহু আনহুম যাদুকরদের হত্যা করেছিলেন।
আজ কাল মানুষ যাদু ও যাদুকরদের ব্যাপারে ঢিলামি ও শৈথিল্য প্রদর্শন করছে। বরং হয়তো অনেকেই একে এমন এক শিল্প হিসাবে গণ্য করছে যা তাদের গর্বের বিষয় এবং এর চর্চাকারীদের উৎসাহিত করার জন্য তারা বহু পুরস্কার প্রদান করছে। যাদুকরদের সম্মানে তারা বিভিন্ন উৎসব ও প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করছে, যাতে হাজার হাজার দর্শক চিত্ত- বিনোদন ও উৎসাহ প্রদানের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হয়ে থাকে। এসব কিছুই মূলত: দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতা, আক্বীদার ব্যাপারে গাফিলতি ও শৈথিল্য প্রদর্শন এবং দ্বীন ও আক্বীদা নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে, তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ারই নামান্তর।
২.ভাগ্য গণনা ও দৈব কর্ম:
এ উভয় ক্ষেত্রে গায়েবী এলেম ও অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে জানার দাবী করা হয়। যেমন ভবিষ্যতে পৃথিবীতে কি হবে এবং কি ফলাফল অর্জিত হবে, হারানো বস্তুর প্রাপ্তিস্থান কোথায় প্রভৃতি সম্পর্কে খবর দেয়া, যা তারা শয়তানদের মাধ্যমে জেনে থাকে। আর শয়তানরা চুরি করে শোনার মাধ্যমে আসমান থেকে এসব সংবাদ সংগ্রহ করে থাকে। আল্লাহ বলেন:

هَلْ أُنَبِّئُكُمْ عَلَى مَنْ تَنَزَّلُ الشَّيَاطِينُ ﴿২২১﴾ تَنَزَّلُ عَلَى كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٍ ﴿২২২﴾ يُلْقُونَ السَّمْعَ وَأَكْثَرُهُمْ كَاذِبُونَ﴿২২৩﴾ سورة الشعراء

‘আমি আপনিকে বলব কি, কার নিকট শয়তানরা অবতরণ করে? তারা অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক মিথ্যাবাদী, গুনাহ্‌গারের উপর। তারা শ্রুত কথা এনে দেয় এবং তাদের অধিকাংশই মিথ্যাবাদী.'[৪]
এটা এভাবে হয় যে, শয়তান ফিরিস্তাদের কিছু কথা চুরি করে শোনে এবং দৈবজ্ঞের কানে তা ঢেলে দেয়। অত:পর দৈবজ্ঞ এ কথার সাথে নিজের পক্ষ থেকে আরো শত মিথ্যা বানিয়ে তা পেশ করে। আর মানুষ আসমান থেকে শোনা সত্য কথাটির কারণে তার সকল মিথ্যাকে সত্য বলে মনে নেয়। অথচ শুধু আল্লাহরই গায়েব সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন। অতএব যদি কেউ দাবী করে যে, সে ভাগ্য গণনা ও দৈববিদ্যা বা অন্য কোন মাধ্যমে এই জ্ঞানে আল্লাহর সাথে শরীক অথবা কেউ এরকম দাবীদারকে সত্যবাদী মনে করে, তাহলে সে আল্লাহর জন্য যা খাস তাতে তাঁর শরীক স্থির করলো।
স্বয়ং দৈব কর্মও শিরক থেকে মুক্ত নয়। কেননা এতে শয়তানদের উদ্দেশ্যে তাদের প্রিয় জিনিস পেশ করে তাদের নৈকট্য অর্জন করা হয়। ফলে এতে আল্লাহর এলেমে তার শরীক হবার দাবী করার মাধ্যমে একদিকে যেমন রুবুবিয়াতে শিরক করা হচ্ছে, তেমনি অন্য দিকে কিছু ইবাদতের মাধ্যমে গায়রুল্লাহর নৈকট্য অর্জনের কারণে উলুহিয়াতেও শিরক করা হচ্ছে। আবু হোরায়রা রাদি আল্লাহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

مَنْ أتَى كَاهِناً فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُوْلُ فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أنْرِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَ

‘যে ব্যক্তি কোন দৈবজ্ঞ ও ভাগ্য গণনাকারীর কাছে আসে এবং সে যা বলে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, সে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি অবতীর্ণ সত্যের প্রতি কুফুরী করল'[৫]
বর্তমানে এ ব্যাপারে নিজে সাবধান হওয়া ও লোকজনকে সাবধান করা জরুরি যে যাদুকর, ভাগ্য গণনাকারী, দৈবজ্ঞ সকলেই মানুষের আক্বীদা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। তারা নিজেদেরকে চিকিৎসকরূপে পেশ করছে। আর রোগ- ব্যাধিগ্রস্ত লোকদেরকে গায়রুল্লার উদ্দেশ্যে যবেহ ও কুরবানী করার নির্দেশ প্রদান করছে। যেমন অমুক অমুক ধরনের বকরী বা মুরগী যেন তারা যবেহ করে।
অথবা তারা রোগীদেরকে শিরকী কবচ ও শয়তানী তাবীয লিখে দেয়। অত:পর তা কৌটায় পুরে রোগীদের গলায় ঝুলিয়ে দেয় কিংবা তাদের সিন্দুকে বা ঘরে রেখে দেয়।
কেউ কেউ আবার নিজেকে অদৃশ্য বিষয়ের সংবাদদাতা ও হারানো বস্তুর প্রাপ্তিস্থান অবহিতকারী হিসাবে জাহির করে। ফলে তার কাছে অজ্ঞ ও মূর্খ লোকেরা এসে হারিয়ে যাওয়া বস্তু সমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। অতঃপর সে তাদেরকে এ বস্তুর খবর দেয় কিংবা নিজেই তা শয়তান সহচরদের মাধ্যমে তাদের জন্য হাযির করে।
কেউ কেউ আবার নিজেকে অলৌকিক ক্ষমতা ও কারামাতের অধিকারী অলী হিসাবে প্রকাশ করে। যেমন সে অগ্নিতে প্রবেশ করে, অথচ আগুন তার উপর কোন আছর করে না। সে নিজেকে অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে কিংবা গাড়ীর চাকার নীচে নিজেকে পিষ্ট করে, অথচ তার গায়ে আঘাত ও পিষ্ট হওয়ার কোন চিহ্নই থাকে না। এছাড়া সে আরো নানা ধরনের ভেলকি দেখিয়ে থাকে, যা প্রকৃত পক্ষে যাদু ও শয়তানী কাজেরই শামিল, যাতে কোন বাস্তবতাই নেই। বরং এগুলো গুপ্ত কৌশল ও ছলনা যা তারা মানুষের সামনে নিপুণভাবে উপস্থাপন করে। যেমন ফেরাউনের যাদুকররা লাঠি ও রশি দিয়ে যাদু দেখিয়েছিল।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া কিছু সংখ্যক বাতায়েহী আহমাদী (রিফায়ী) নামধারী যাদুকরদের সাথে তার বিতর্ক প্রসঙ্গে বলেন, বাতায়েহীদের নেতা উচ্চস্বরে বলল: আমাদের এমন এমন অবস্থা ও বিষয়-আশয় রয়েছে। এরপর সে অগ্নি ইত্যাদির আছর দূর করার মত তাদের অলৌকিক শক্তির দাবী করে বসল এবং বলল যে, সে কারণে তাদের এই অবস্থাগুলো মেনে নেয়া উচিত। শায়খুল ইসলাম বলেন: আমিও তখন রেগে-মেগে উচ্চস্বরে বললাম যে, আমি দুনিয়ার পূর্ব পশ্চিমের সকল আহমদীকে বলতে চাই তারা আগুনে প্রবেশ করে যা করবে, আমিও হুবহু তাই করতে পারব। এতে যে পুড়ে যাবে সে পরাজিত হবে। বোধ হয় এও বলেছি যে, তার উপর আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হবে। তবে এ কাজ করতে হবে আমাদের দেহ সিরকা ও গরম পানি দিয়ে ধৌত করার পর। এ কথা শুনে আমির উমারা ও সাধারণ লোকজন এর কারণ সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করল। আমি বললাম, আগুন নিয়ে এসব করার মধ্যে তাদের কিছু ছল-চাতুরী রয়েছে। তারা ব্যাঙের তেল, নারকেলের খোসা ও তালক নামক এক প্রকার পাথর দ্বারা কিছু জিনিস তৈরি করে শরীরে মাখে। এতে লোকজন হৈ-চৈ শুরু করে দিল। তা দেখে সে লোকটি জাহির করতে লাগলো যে, সে এমতাবস্থায় ও অগ্নিতে প্রবেশ করতে সক্ষম এবং বলল, আমাদের শরীর বারুদ দিয়ে মেখে আমাকে ও আপনাকে একটি কুঠুরিতে লেপ্টে রাখা হোক। আমি বললাম, চলুন ঠিক আছে। এ কাজ সম্পন্ন করার জন্য আমি বারবার তাকে তাগাদা দিতে লাগলাম। এতে সে হাত বাড়িয়ে জামা খোলার ভাব দেখাল। আমি বললাম, গরম পানি ও সিরকা দিয়ে গোসলের আগে নয়। এর পর অভ্যাসানুযায়ী সে স্বীয় ধারণা ব্যক্ত করে বলল, যে আমীরকে ভালোবাসে সে যেন কাঠ নিয়ে আসে অথবা বলল, সে যেন এক বোঝা লাকড়ি নিয়ে আসে। আমি বললাম, লাকড়ি আনতে গেলে দেরি হয়ে যাবে এবং লোকজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়বে। ফলে উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। তার চেয়ে বরং একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে আমার ও আপনার আঙুল ধুয়ে তাতে প্রবেশ করাই। এতে যার আঙুল পুড়ে যাবে তার উপর আল্লাহর লা’নত পড়বে অথবা বললাম, সে পরাজিত হবে। আমি এ কথা বললে সে বদলে গেল এবং লাঞ্ছিত ও অপমানিত হল[৬] এ ঘটনা বর্ণনার উদ্দেশ্য হল এ বিষয় স্পষ্ট করে তোলা যে, এসব দুষ্ট লোকেরা এ ধরনের গুপ্ত ছল-চাতুরী দিয়ে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে মিথ্যা কথা পরিবেশন করে।
সমাপ্ত
——————————————————————————–
[১] বুখারী, মুসলিম।

[২] সূরা বাকারা, ১০২।

[৩] সূরা বাকারা, ১০২।

[৪] সূরা আশ শুআরা, ২২১-২২৩।

[৫] আবু দাউদ।

[৬] মাজমুউল ফাতাওয়া একাদশ খন্ড ৪৪৬-৪৬৫।
লেখক : সালেহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান

تأليف : صالح بن فوزان الفوزان

অনুবাদক : মুহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

ترجمة : محمد منظور إلهي

সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ

المكتب التعاوني للدعوة وتوعية الجاليات بالربوة بمدينة الرياض