মসজিদ নিয়ে আল্টিমেটাম দেওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়, বরং ইংরেজ আমলে প্রতিষ্ঠিত দেওবন্দীদের পুরনো বদ খাসলত

msjid

সম্প্রতি এই রমাদান মাসে সিলেটে অবস্থিত দুটো সালাফী মসজিদ উচ্ছেদের জন্য ৭২ ঘণ্টা আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছিল ও কিশোরগঞ্জের একটি হামলা করে ভাঙচুর করা হয়েছে। নিকট অতীতে খুলনার একটি সালাফী মসজিদও ভাঙচুর করা হয়েছিল। দুঃখজনক ব্যাপার হল এগুলো যারা করেছে, তারা কোন ইহুদী-খৃস্টান বা মুশরিক নয়, বরং ঈমানের দাবীদার মুসলিম! অথচ আমরা মুশরিকদের মাধ্যমে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার বিষয়ে আন্দোলন করি, মাসজিদুল আকসার মধ্যে ইয়াহুদী নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করি!
অনেকেই এই ধরণের ঘটনা শুনে হয়তো চোখ ছানাবড়া করে ফেলেছেন! তারা ভাবছেন এ ধরণের ঘৃণিত কাজ কীভাবে সম্ভব! তবে যারা ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন তারা এই সমস্ত ঘটনা নিয়ে অবশ্যই দুঃখিত, কিন্তু মোটেই বিস্মিত নন। কারণ তারা বেশ ভালভাবেই জানেন যে, ভারতীয় উপমহাদেশে আহলে হাদীসের বিরুদ্ধে মসজিদ নিয়ে হানাফী মুকাল্লিদদের মামলা-হামলা এবং মসজিদ থেকে বলপূর্বক বের করে দেওয়ার ঘটনা সেই ইংরেজ আমল থেকেই অহরহ ব্যাপার। জোরে আমীন বলা, রফঊল ইয়াদাইন করা, সূরা ফাতিহা পড়ার কারণে তারা আহলে হাদীসের বিরুদ্ধে শত শত মামলা করেছে।
নিম্নে আহলে হাদীসদের বিরুদ্ধে এরূপ দশটা মামলা তুলে ধরা হল: 
১) মুকদ্দমা অমৃতসর ১৮৭০, ১৮৭৫।
২) উলূ মসজিদ মদনপুর, বানারাস।
৩) কাসগঞ্জ জেলা ইটা, ১৯২৯।
৪) দিল্লী, ১৮৮৩।
৫) পাটনা, ১৮৯৭।
৬) দুমারো, আরাহ, ১৮৯৭।
৭) যোধপুর, মারুওয়ার, ১৯০৩।
৮) মধুপুর, জীপুর, ১৯১১।
৯) রতনপুর, মুরাদাবাদ, ১৯১২।
১০) কাটপাহ, ১৯১২।
মুকাল্লিদ ভাইয়েরা শুধু মামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং মিথ্যা সব অভিযোগের পসরা সাজিয়ে কিতাব লিখেছে, যেন এর মাধ্যমে জনসাধারণকে খেপিয়ে তুলে আহলে হাদীসদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দেয়া সহজ হয়। সেসব কিতাবে তারা এতোটাই হীন মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে যা ভাবতেই গাঁ শিউরে উঠে। তারা সেসব কিতাবে আহলে হাদীসদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দেওয়ার ফাতওয়া প্রদান করে। তারা এও লিখে যে, আহলে হাদীস কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট। কুকুর মসজিদে প্রবেশ করলে নাপাক হয় না। কিন্তু আহলে হাদীসেরা মসজিদে প্রবেশ করলে মসজিদ নাপাক হয়ে যায়। মসজিদে ধৌত করলেও নাপাকী দূর হবেনা। বরং মসজিদের কার্পেট বাইরে ফেলে দিতে হবে।

আমরা সেসব ফাতওয়া সম্বলিত কিতাব থেকে লেখকের নামসহ মাত্র দশটি কিতাবের নাম উল্লেখ করলাম:

১) জামিউশ শাওয়াহেদ ফী ইখরাজিল ওয়াহাবিয়্যিন আনিল মাসাজিদ। লেখক, ওয়াসী আহমাদ পিলীভিনী। উক্ত কিতাবের বিরুদ্ধে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ রহি. মুখ খুলতে বাধ্য হন। তার বক্তব্য দেখুন ‘আযাদ কী কাহানী আযাদ কী যুবানী’ পৃষ্ঠা ১০৬।
২) ইন্তিযামুল মাসাজিদ বিইখরাজে আহলিল ফিতান ওয়াল মাফাসিদ। লেখক, মৌলবী মুহাম্মাদ লুধিয়ানী।
৩) ইখরাজুল মুনাফিকীন আন মাসাজিদিল মুসলিমীন। লেখক, মৌলবী নবী বখশ হালওয়ায়ী।
৪) সাইফুল জাব্বার। লেখক, ফজলে রাসূল বাদাইউনী।
৫) তাসহীহুল মাসায়েল। লেখক, ফজলে রাসুল বাদাইউনী।
৬) আল-বাওয়ারিকুল মুহাম্মাদিয়্যাহ লিরাজমে শায়াতীনে নাজদীয়্যাহ। লেখক, ফজলে রাসুল বাদাইউনী।
৭) ইহকাকে হাক্ব ও ইবতালে বাতেল। লেখক, ফজলে রাসুল বাদাইউনী।
৮) তুহফায়ে মুহাম্মাদিয়্যাহ ফী রাদ্দে ওয়াহাবিয়্যিহ। লেখক, আব্দুল ফাত্তাহ গুলশানাবাদী।
৯) তুহফায়ে হারামাইন শারিফাইন। মৌলবী সেরাজুল হক।
১০) শামসুল ঈমান। লেখক, ঈমাদুদ্দীন সাম্ভালী।

কেউ কেউ হয়তো আপত্তি করবেন, আহলে হাদীসেরা এসব ফুরূয়ী মাস’আলা বাড়াবাড়ি করেছে বিধায় তাদের বিরুদ্ধে হানফি মুকাল্লিদেরা এরূপ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তবে তাদের এই বক্তব্য সঠিক নয়। তাই আসুন জেনে নেই, ফুরূয়ী মাস’আলা নিয়ে কারা প্রথমে বাড়াবাড়ি করেছে? ইতিহাস ঘটলে খুব সহজেই জানা যায় যে, ফুরূয়ী মাস’আলা সর্বপ্রথম হানাফীরা বাড়াবাড়ি করে। এমনকি, এসব মাস’আলার কারণে সালাত বাতিলের হুকুম জারি করে।


নিম্নে কয়েকটি ফুরূয়ী মাস’আলার বাড়াবাড়ির ইতিহাস তুলে ধরা হলঃ 
১) রফউল ইয়াদাইন করলে সালাত বাতিল হয়ে যাবে। আমীর কাতিব ইতকানী হানাফী রফউল ইয়াদাইন করলে সালাত বাতিল হয়ে যাবে- মর্মে এক স্বতন্ত্র পুস্তিকা লেখেন। তার প্রতিবাদ করেছেন আল্লামা লাখনাভী রাহিমাহুল্লাহ্। (আল-ফাওয়াইদুল বাহিয়াহ, ৫০)
২) ফাতিহাহ খালফাল ইমাম, ইমামের পিছনে সুরা ফাতিহা পড়লে নামাজ বাতিল হয়ে যাবেঃ ইমামের পিছনে সূরাহ ফাতিহাহ পড়লে সালাত বাতিল হয়ে যাবে, তার মুখে আগুন লাগিয়ে দিতে হবে এবং সে ফাসেক হয়ে যাবে। ( ইমামুল কালাম, ৪০; দুররুল মুখতার, ১/৫৪৪,৫৫৫)
৩, ৪, ৫) তাশাহহুদে আঙ্গুল ইশারা করা, উঁচু আওয়াজে বিসমিল্লাহ বলা ও জোরে আমীল বলা সালাতের হারাম বস্তু- এরুপ মত দিয়েছেন হানাফী আলেম কীদানী। (খোলাসায়ে কীদানী, ১৫, ১৬)
অনেকেই আবার এভাবে অভিযোগ করে থাকেন যে, আপনারা ‘আহলে হাদীস মসজিদ’ নাম দিয়ে কেন বিভক্তি সৃষ্টি করছেন? এক্ষেত্রে আমাদের সংক্ষিপ্ত জবাব হচ্চগে, আসলে আমরা কোনদিন মসজিদ বিভক্ত করতে চাইনি। আমরা এক মসজিদেই মিলেমিশে থাকতে চেয়েছিলাম। শাইখুল কুল ফিল কুল নাযীর হুসাইন দেহলভী আমৃত্যু হানাফী মসজিদে সালাত আদায় করেছেন। এমন অসংখ্য নজির আছে যে, আহলে হাদীসদেরকে যেন হানাফী মসজিদে বাধা প্রদান না করে সলাত আদায় করার সুযোগ করে দেওয়া হয়, সেজন্য তারা কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন।

এখানে এরুপ দশটি ঘটনা উল্লেখ করা হলঃ
১) নাসীরাবাদ, আজমীর, ১৮৮৪।
২) মীরাঠ, ১৮৮৬।
৩) আলীগড়, ১৮৯৯।
৪) আরাহ, ১৮৯৩।
৫) বানারস, ১৮৯৬।
৬) কিকড়ী আজমীর, ১৯০৫।
৭) আম্বালা ছাউনি, ১৯১২।
৮) কোটা রাজপুতানা, ১৯১২।
৯) কিশানগড়, ১৯১২। ১০) আগরা, ১৯০৪।
এতো কিছুর পরেও যখন হানাফী মুকাল্লিদেরা ঘারধাক্কা দিয়ে আহলে হাদীসকে মসজিদ থেকে বের করে দেয়, তখন তারা কী করবে? হয় সালাত ঘরে বসে আদায় করবে বা সালাত পরিত্যাগ করবে অথবা কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী বিশুদ্ধভাবে সলাত আদায় করার উদ্যেশ্যে আলাদা মসজিদ নির্মাণ করবে? এক্ষেত্রে প্রথম দুটি অভিমত শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সুতরাং তারা নিরুপায় হয়ে তৃতীয় পন্থা অবলম্বন মসজিদ নির্মাণ করে আহলে হাদীস মসজিদ নাম দেয়। যাতে যে কোনো মুসলিম সেই মসজিদে প্রবেশ করে নির্ভয়ে সলাতটা আদায় করতে পারে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে যখনই নিরুপায় হয়ে এরুপ মসজিদ নির্মাণ করা হয়, তখন আহলে হাদীসদের উপর উম্মতের মধ্যে বিভক্তি ও ফিতনা ছড়ানোর অভিযোগ আরোপ করা হয়, যা নিতান্তই হাস্যকর ও কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যাপার! মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে হিদায়াত দান করুন।
লেখক- Abdullah Mahmud