বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এজন্য আপনার উচিত কিছু বিষয় জেনে নেয়া। কিছু বিষয়ে অভিজ্ঞ ও হিতাকাঙ্খিদের পরামর্শে কাজ করা।

বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেক দিনের জল্পনা-কল্পনার পর পাত্রী/পাত্রের সাথে কথা বলতে যাবেন। কি বলবেন? কি কি দিকে গুরুত্ব দেয়া উচিত? এ নিয়ে নিজে ভেবেই হয়ত অনেক কিছু তৈরী করে ফেলেছেন। কিন্তু লক্ষ্য যেখানে একটি সুন্দর দাম্পত্য ও আদর্শ পরিবার গঠন সেখানে এ বিষয়ে ‘নিজে কিছু ভেবেই’ সিদ্ধান্ত নেয়াটা বোকামী। এজন্য আপনার উচিত কিছু বিষয় জেনে নেয়া। কিছু বিষয়ে অভিজ্ঞ ও হিতাকাঙ্খিদের পরামর্শে কাজ করা।

প্রথমেই আমি আপনাদের যার পরামর্শ গ্রহণ করতে বলবো তিনি আমাদের একান্ত বিশ্বস্ত ও ভালবাসার পাত্র, দুনিয়ার বুকে যাকে আল্লাহর পরে সবচেয়ে ভালবাসি সেই একান্ত শুভাকাঙ্খি, যিনি তার অনুসারীদের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণার্থে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন, তাদের জন্য অশ্রু সিক্ত নয়নে যিনি সবসময় কাঁদতেন সেই মহান নেতা রাসূলুল্লাহ সা. এর। তিনি আমাদের বলেছেন,
চারটি জিনিস দেখে একজন নারীকে বিয়ে করা হয়; তার সম্পদ, বংশমর্যাদা, রূপসৌন্দর্য ও দ্বীনদারী। তোমরা বিয়ের সময় দ্বীনদার নারীদের অগ্রাধিকার দাও। “
[বুখারী/৫০৯০]

-লক্ষ্য করুন এখানে বলা হয়েছে সাধারণত মানুষেরা এ চারটি দিক দেখে কিন্তু তোমরা একমাত্র দ্বীনদারীতাকেই প্রাধান্য দিবে। এটা বোঝানো হয়নি যে চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে।

>>> তো আমরা কিভাবে দ্বীনদারীতা দেখবো অথবা বিয়ের ক্ষেত্রে আমাদের কি কি বিষয় দেখে দ্বীনদারীতা বুঝতে হবে বা এগুতে হবে তা জেনে নেয়াটা আবশ্যক। আসুন তা সংক্ষেপে জেনে নেই।

রাসূল সা. এর পরামর্শ পালনার্থে আপনাকে সাতটি বিষয় খুব খেয়াল করা প্রয়োজন। এখানে যেসব বিষয় আলেচিত হচ্ছে তা পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য প্রযোজ্য।

প্রথমত, ইসলাম
প্রথমেই আপনাকে জেনে নিতে হবে যে আপনার সম্ভাব্য জীবনসঙ্গী ইসলামের নূন্যতম মৌলিক বিধিনিষেধগুলো পালন করে কি না। ব্যাপারগুলো যাচাই করতে যা যা করতে পারেন,
>১> প্রথমেই জেনে নিতে পারেন তিনি তাওহীদ ও শিরক বিষয় স্ববিস্তারে জানেন কিনা। এ বিষয় সতর্ক কিনা যেহেতু তা কালিমা পূরণের শর্ত। জেনে নিন তিনি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেন কিনা। করলে সেটার ধরণ কিরকম। ফজরের সলাত নিয়মিত পরে কিনা। জামাআতে সলাতকে গুরুত্ব দেয় কিনা। বাসায় বা পরিচিত মহলে ছোটদের নিয়ে সালাত আদায় করতে চেষ্টা চালায় কিনা। সাওম (রোজা), যাকাত, পর্দা, মাহরাম-ননমাহরাম বেছে চলার বিষয় সচেষ্ট কিনা। *স্বাচ্ছন্দে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে কিনা। কেননা, যেসব নারীপুরুষরা বিয়ে করার মতো পরিণত বয়সে উপনীত হয়েও শুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে পারে না বিষয়টা মুসলিম হিসেবে খুবই লজ্জাকর একটি বিষয়।
এরপর চারিত্রিক বিষয় জেনে নিতে পারেন, তার সাহস, ধৈর্য, আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস, স্বভাব ধীরস্থীর কিনা, পুরুষের পৌরুষদীপ্ততা, নারীর লজ্জাশীলতা, বিনয়, যেকোন পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারা, শান্তিপূর্ণ সহবস্থান, নীরবতায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা, বাচাল প্রকৃতির না হওয়া, চিন্তার গভীরতা ইত্যাদি
>> বাহ্যিক দিক, মেয়েদের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখুন সে পরিপূর্ণ পর্দা করে কিনা, আর ছেলেদের ক্ষেত্রে দাড়ি। রুচিশীল ও বুদ্ধিমতি কোনো মেয়ে নিশ্চয়ই এমন একজন পৌরুষহীন পুরুষকে বিয়ে করতে চাইবে না, যাকে দেখতে মেয়েদের মতো লাগে! এছাড়া একমাত্র আল্লাহভীরু যুবকই পারে দাড়িকে সুন্নাহ অনুযায়ী রাখতে। বাকিরা হয়ত জাহেলদের অনুকরণে স্মার্ট! ভাবে দাড়ি না রেখে বা স্টাইল করে দাড়ি রেখে। অপরদিকে পর্দা, লজ্জাশীলতা ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের বহ্যিঃপ্রকাশ। এটা হতে হবে পরিপূর্ণ পর্দা। যারা মাহরাম-ননমাহরাম বেছে চলে। সাধারণভাবেতো অনেককেই পর্দানশীলা মনে হতে পারে কিন্তু হয়ত তারা অনেকেই মাহরাম-ননমাহরামের বিষয়গুলো জানেই না।

মনে রাখবেন যে আল্লাহর কথাই গুরুত্ব দেয়না, সে একসময় আপনার কথাকেও পাত্তা দেবে না। যেকোন বিরোধ মীমাংসায় আপনাদের উভয়ের শেষ আশ্রয় হতে হবে কুরআন ও সুন্নাহ। হতে পারে বিয়ের কয়েকমাস পরেই আপনাদের বাহ্যিক রূপলাবন্য বা স্মার্টনেসের আকষর্ণ হারিয়ে যাবে তখন যেটা গুরুত্বপূর্ণ হবে তা হচ্ছে আপনাদের দ্বীনদারীতা, সচেতনতা। তাই যে আপনার সন্তানের পিতা/মাতা হবে তাকে নির্বাচনে দ্বীনকে ছাড় দিলেন তে দুনিয়া-আখিরাত উভয়েই ডোবালেন!

দ্বিতীয়ত মনে রাখুন, প্রেমে_পড়া_থেকে_বাঁচুন
আপনি বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, প্রেম হচ্ছে শারীরিক আকর্ষণের অন্য নাম মাত্র। সচরাচর এটা খুবই ক্ষণস্থায়ী হয়। আপনি আপনার দাম্পত্যকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চাইলে সম্মানবোধকেই গুরুত্ব দিতে হবে। আর যদি নিজেকে তৈরী করে নিতে পারেন তাহলে আপনার সঙ্গী যেই হউক সম্মানবোধ আপনার প্রতি তার থাকবে আর সেটাই একসময় দীর্ঘস্থায়ী ভালবাসার সৃষ্টি করবে। আর সে ভালবাসা যুগান্তরে ছড়িয়ে যাবে তাও শেষ হবে না। তাই আগেই প্রেমে পড়ে যাওয়া থেকে বেঁচে থাকুন। বরং নিজেকে তৈরী করুন। এমনকি অনেকে পাত্র/পাত্রী দেখার সময়ও প্রেমে পড়ে যান আর বিয়ের মত এত গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে যেসকল দিককে অবশ্যই গুরুত্ব দেয়া উচিত তাকেও উপেক্ষা করে বসেন অথবা ভুলে বসেন। এটা তাদের উভয়ের জন্য পরবর্তীতে মারাত্মক হয়।

তৃতীয়ত দেখুন, আচার_আচরণ
অনেকেই যে ভুলটা করে সেটা হচ্ছে, এটা ভাবা যে কেউ দ্বীনদার হলেই তার চরিত্র, আচার-আচরণ তো ভালোই হবে। কিন্তু দ্বীন পালনের দিক থেকে ভালো হওয়া সত্ত্বেও সবার আচার-আচরণ ভালো না-ও হতে পারে। কিন্তু এটা আপনাদের দাম্পত্যের জন্য খুবই জরূরী একটি বিষয়। তাই কেমন আচরণ পেতে যাচ্ছেন তা আগেই বুঝে নিন। আর মনে রাখুন, আচরণই ঘরকে জান্নাত করে- বাহ্যিকভাবে সে যতই নামাজ, রোজা, ইলম ইবাদাতগুজার হউক না কেন অথবা সৌন্দর্য্যে যতই আকৃষ্ট হউক না কেন আচরণ খারাপ হলে সে ঘর জাহান্নামে পরিণত হয়।

চতুর্থত গুরুত্ব দিন কথোপকথন -কে
তার সাথে কথা বলুন। তাকে কথা বলতে দিন। তার জ্ঞানের গভীরতা, গঠনমূলক চিন্তাভাবনা, কোন পরিস্থিতির ব্যাপারে তার সামগ্রিক বিবেচনা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন। তার পছন্দ অপছন্দ জেনে নিন। যে কি ধরণের বই পড়তে ভালবাসে, কাদের বই পড়ে তা জানার চেষ্টা করুন। সে সমালোচনা করতে পছন্দ করে নাকি ভুলত্রুটিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে তা বোঝার চেষ্টা করুন। সে কি অন্যের ভুল নিয়ে কথা বলে নাকি ভুলের কারণ খুঁজতে চেষ্টা করে তা খেয়াল করুন। মতোবিরোধপূর্ণ বিষয়ে তার অবস্থান আপনার সাথে মিলে কিনা তা যাচাই করে নিন।
মনে রাখবেন দাম্পত্যে পারস্পরিক কথোপকথান-ই এর জীবনীশক্তি। সাচ্ছন্দ্যে যার সাথে কথা বলতে পারেন তাকে নিয়েই সুখি দাম্পত্য গড়ে তোলা সহজ।

পঞ্চমত, অভিন্ন_লক্ষ্য
দুজনের জীবনে কিছু অভিন্ন লক্ষ্য থাকা চাই। তাহলে অন্তত এই অভিন্ন লক্ষ্যে উভয়ের এগিয়ে চলায় একে অপরের সহায়ক শক্তি হতে পারবেন আপনারা। মনে রাখুন, দীর্ঘকালীন পরিকল্পনাগুলোকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার মাঝেই লুকিয়ে আছে দাম্পত্য জীবনের গোপন রহস্য।

ছষ্ঠত, পারিবারিক_পরিবেশ_বিষয়_সচেতনতা
সম্ভাব্য জীবন সঙ্গীর পরিবারের দিকে খেয়াল করুন। তাদের আকীদাহ, সংস্কৃতি, আচার, রীতি ইত্যাদি প্রতিটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিছু আদর্শ, পরিবেশ ও আকীদাগত বিষয় আছে এমন যে বিষয়ে আপস চলে না। সেসব বিষয় গুরু্ত্ব নিয়ে দেখুন। একক ও যৌথপরিবারের সুবিধা-অসুবিধা ও মানসিক নানা বিষয় আপনার নিজের জানা উচিত। সেসব দিকে বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিন।

সপ্তমত, ইস্তেখারা
বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের বিষয়। আর মুসলিমরা যেকোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধাতে আল্লাহর সাহায্য গ্রহণ করে। তাই বেশি বেশি দুআ করুন যেন আল্লাহ কল্যাণ থাকলে এই প্রপোসালটি সামনে এগুনো সহজ করেন। ইস্তেখারার দুটি পর্যায়, একটি হচ্ছে দুআ করা অপরটি হচ্ছে পরামর্শ গ্রহন। তাই দুআর পাশাপাশি অভিজ্ঞ কোন আলেম বা পরামর্শক যিনি দ্বীনের জ্ঞান রাখেন, আল্লাহকে ভয় করেন ও আপনার হিতাকাঙ্খি তার সাথে সামগ্রিক বিষয় পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিন। সাথে সাথে ইস্তেখারা চালিয়ে যান।

পরিশেষে বলতে চাই, হিদায়াত আল্লাহর হাতে। ‘গড়ে নিবো’, ‘বদলে ফেলবো’ ইত্যাদি টাইপের কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। আপনি যদি এমন মানুষকে বিয়ে করতে চান যার পরিবর্তন প্রয়োজন, তাহলে সে কাজটি আপনি তাকেই করতে দিন। আপনি কি জানেন যে, পৃথিবীর ৯৯.৯% মানুষই এই ধারণা রাখে যে সে মানুষকে বদলাতে পারে! তাই এ ভুল করবেন না বরং এমন কাউকে খুজে বের করুন যাকে দেখে আপনি মুগ্ধ হবেন;
আর মনে রাখুন, “অন্যের মাঝে যে জিনিসগুলো খুজছি, আমার মধ্যে সেগুলো কতটুকু আছে? আমি নিজে কতগুলো শর্ত পূরণ করতে পেরেছি? যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি আমি কি তার একজন ভালো জীবনসঙ্গী হতে পারবো? আমি যেমন ভুল-ত্রুটি নিয়ে মানুষ, তেমনি আমার সঙ্গীটিরও ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে, আমাকেই বুঝে নিতে হবে আদর্শ দাম্পত্যের জন্য কোন বিষয়কে আমি গুরুত্ব দিবো আর কোন বিষয়কে উপেক্ষা করব।”

.
অনুরোধ যারা আরো গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চান অথবা যারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাদের সবাইকে শাইখ মির্জা ইয়াওয়ার বেগ-এর “বিয়ে: স্বপ্ন থেকে অষ্টপ্রহর” বইটি বারবার পড়ার অনুরোধ রইল। আজই সংগ্রহ করুন।
.

প্রচারে আন-নূর ইসলামিক ম্যারেজ মিডিয়া।