ঈদে যা বর্জন করা উচিত

ঈদ হল মুসলিমদের শান-শওকত প্রদর্শন, আত্মার পরিশুদ্ধি, তাদের ঐক্য সংহতি ও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উৎসব। কিন্তু দু:খজনক হল বহু মুসলিম এ দিনটাকে যথার্থ মূল্যায়ন করতে জানে না। তারা এ দিনে বিভিন্ন অনৈসলামিক কাজ-কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
এ ধরনের কিছু কাজ-কর্মের আলোচনা পেশ করা হল :

(১) কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য রাখে এমন কাজ বা আচরণ করা
মুসলিম সমাজে এ ব্যাধি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা পোশাক-পরিচ্ছদে, চাল-চলনে, শুভেচ্ছা বিনিময়ে অমুসলিমদের অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। এর মাধ্যমে তারা যেমন সাংস্কৃতিক দৈন্যতার পরিচয় দিচ্ছে অপর দিকে নিজেদের তাহজিব-তামাদ্দুনের প্রতি অনীহা দেখাচ্ছে।

এ ধরনের আচরণ ইসলামি শরিয়তে নিষিদ্ধ। হাদিসে এসেছে,
عن عبد الله بن عمرو رضى الله عنهما أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : من تشيه بقوم فهو منهم. رواه أبو داود ৪০৩১ وصححه الألباني
সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সাদৃশ্য রাখবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে।[১১২]

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, হাদিসের বাহ্যিক অর্থ হল যে কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য রাখবে সে কাফের হয়ে যাবে। যদি এ বাহ্যিক অর্থ (কুফরির হুকুম) আমরা নাও ধরি তবুও কমপক্ষে এ কাজটি হারাম তো হবেই।[১১৩]

(২) পুরুষ কর্তৃক মহিলার বেশ-ধারণ করা ও মহিলা কর্তৃক পুরুষের বেশ ধারণ
পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন ও সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে পুরুষের মহিলার বেশ ধারণ ও মহিলার পুরুষের বেশ ধারণ করা হারাম। ঈদের দিনে এ কাজটি অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়।

হাদিসে এসেছে,
عن ابن عباس رضى الله عنهما عن النبي صلى الله عليه وسلم : أنه لعن المتشبهات من النساء بالرجال والمتشبهين من الرجال بالنساء .رواه أبو داود ৪০৯৭ وصححه الألباني في صحيح أبي داود برقم ৩৪৫৩
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলে কারীম স. ঐ সকল মহিলাকে অভিসম্পাত করেছেন যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে এবং ঐ সকল পুরুষকে অভিসম্পাত করেছেন যারা মহিলার বেশ ধারণ করে।[১১৪]

(৩) ঈদের দিনে কবর জিয়ারত

কবর জিয়ারত করা শরিয়ত সমর্থিত একটি নেক আমল।

যেমন হাদিসে এসেছে,
عن أنس رضى الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : كنت نهيتكم عن زيارة القبور، ألا فزورها فإنها ترق القلب وتدمع العين وتذكر الآخرة، ولا تقولوا هجراً. )صحيح الجامع رقم ৪৫৮৪(
আনাস রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলে কারীম স. বলেছেন : আমি তোমাদেরকে কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, হা, এখন তোমরা কবর জিয়ারত করবে। কারণ কবর জিয়ারত হৃদয়কে কোমল করে, নয়নকে অশ্রুসিক্ত করে ও পরকালকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে তোমরা শোক ও বেদনা প্রকাশ করতে কিছু বলো না।[১১৫]

কিন্তু ঈদের দিনে কবর জিয়ারতকে অভ্যাসে পরিণত করা বা একটা প্রথা বানিয়ে নেয়া শরিয়তসম্মত নয়।

রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন :
لا تجعلوا قبري عيداً … )رواه أبو داود و ২০৪২ صححه الألباني(
তোমরা আমার কবরে ঈদ উদযাপন করবে না বা ঈদের স্থান বানাবে না…।[১১৬]
যদি ঈদের দিনে কবর জিয়ারত করা হয় তবে কবরে ঈদ উদযাপন বলে গণ্য হয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে ‘ঈদ’ মানে যা বার বার আসে। প্রতি বছর অথবা প্রতি মাসে বা প্রতি বছরে।

যদি বছরের কোন একটি দিনকে কবর জেয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করে নেয়া হয় আর তা প্রতি বছরে করা হয় তা হলে এর নামই হল কবরে ঈদ উদযাপন। আর সেটা যদি সত্যিকার ঈদের দিনে হয় তবে তা আরো মারাত্মক বলে ধরে নেয়া যায়।

যখন আল্লাহ তাআলার রাসূলের কবরে ঈদ পালন নিষিদ্ধ তখন অন্যের কবরে ঈদ উদযাপন করার হুকুম কতখানি নিষিদ্ধের পর্যায়ে পড়ে তা একটু অনুমান করা যেতে পারে।

(৪) বেগানা মহিলা পুরুষের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ

যেমন :

(ক) মহিলাদের খোলা-মেলা অবস্থায় রাস্তা-ঘাটে বের হওয়া।

মনে রাখা প্রয়োজন যে খোলামেলা ও অশালীন পোষাকে রাস্তা-ঘাটে বের হওয়া ইসলামি শরিয়তে নিষিদ্ধ।

আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى (الأحزاب : ৩৩)
‘আর তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন মূর্খতার যুগের মত নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না।'[১১৭]

হাদিসে এসেছে,
عن أبي هريرة رضى الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : صنفان من أهل النار لم أرهما : قوم معهم سياط كأذناب البقر يضربون بها الناس. ونساء كاسيات عاريات، مميلات مائلات، رؤسهن كأسنمة البخت المائلة لا يدخلن الجنة ولا يجدن ريحها، وإن ريحها لتوجد من مسيرة كذا وكذا.) رواه مسلم ২১২৮(
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : জাহান্নাম-বাসী দু ধরনের লোক যাদের আমি এখনও দেখতে পাইনি। (আমার যুগের পরে দেখা যাবে) একদল লোক যাদের সাথে গরুর লেজের ন্যায় চাবুক থাকবে, তা দিয়ে তারা লোকজনকে প্রহার করবে। আর একদল স্ত্রীলোক যারা বস্ত্র পরিহিতা হয়েও বিবস্ত্রার মত হবে, অন্যদের আকর্ষণ করবে ও অন্যেরা তাদের প্রতি আকৃষ্ট হবে, তাদের মাথার চুলের অবস্থা উটের হেলে পড়া কুঁজের ন্যায়। ওরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি তার সুগন্ধিও পাবে না যদিও তার সুগন্ধি বহু দূর থেকে পাওয়া যাবে।[১১৮]

(খ) মহিলাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ

দেখা যায় অন্যান্য সময়ের চেয়ে এই গুনাহের কাজটা ঈদের দিনে বেশি করা হয়। নিকট আত্মীয়দের মাঝে যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ শরিয়ত অনুমোদিত নয় তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ অবাধে করা হয়।

হাদিসে এসেছে,
عن عقبة بن عامر رضى الله عنه أن رسول الله صلى الله قال : إياكم والدخول على النساء، فقال رجل من الأنصار: يا رسول الله أفريت الحمو؟ قال : الحمو : الموت. )رواه مسلم ২১৭২(
সাহাবি উকবাহ ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলে কারীম স. বলেছেন: তোমরা মেয়েদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখবে। মদিনার আনসারদের মধ্য থেকে এক লোক প্রশ্ন করল হে আল্লাহর রাসূল ! দেওর-ভাশুর প্রমুখ আত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি ? তিনি উত্তরে বললেন : এ ধরনের আত্মীয়-স্বজন তো মৃত্যু।[১১৯]

এ হাদিসে ‘হামউ’ শব্দ নেয়া হয়েছে। এর অর্থ এমন সকল আত্মীয় যারা স্বামীর সম্পর্কের দিক দিয়ে নিকটতম যেমন স্বামীর ভাই, তার মামা, খালু প্রমুখ। তাদেরকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করার কারণ হল এ সকল আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমেই বে-পরদাজনিত বিপদ আপদ বেশি ঘটে থাকে। যেমনটি অপরিচিত পুরুষদের বেলায় কম ঘটে।

(৫) গান-বাদ্য

ঈদের দিনে এ গুনাহের কাজটাও বেশি হতে দেখা যায়। গান ও বাদ্যযন্ত্র যে শরিয়তে নিষিদ্ধ এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আবার যদি হয় অশ্লীল গান তাহলে তো তা হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোন ভিন্নমত নেই।

হাদিসে এসেছে,
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : ليكون أقواما من أمتي يستحلون الحر والحرير والخمر والمعازف. )رواه البخاري تعليقا بصورة الجزم، يرقم ৫৫৯০)
রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : আমার উম্মতের মাঝে এমন একটা দল পাওয়া যাবে যারা ব্যভিচার, রেশমি পোশাক, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল (বৈধ) মনে করবে।[১২০]
এ হাদিস দ্বারা বুঝা যায় গান-বাদ্য নিষিদ্ধ। কারণ হাদিসে বলা হয়েছে ‘তারা হালাল মনে করবে।’ এর দ্বারা প্রমাণিত হয় মূলত এটা হারাম।

ইসলামি শরিয়ত কিছু কিছু পর্বে বিনোদনের অনুমতি দিয়েছে। তাই অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম নিম্নোক্ত কয়েকটি সময়ে দফ (একদিকে খোলা ঢোল জাতীয় বাদ্য) বাজানোকে জায়েজ বলেছেন।

[(ক) বিবাহের অনুষ্ঠানে। হাদিসে এসেছে,

عن الربيع بنت معوذ بن عفراء قالت : جاء النبي صلى الله عليه وسلم حين بني علي فجلس على فراشي كمجلسك مني ، فجعلت جويريات لنا يضربن بالدف، ويندبن من قتل من آبائي يوم بدر، إذ قالت إحداهن : وفينا نبي يعلم ما في غد. فقال : دعي هذه وقولي بالذي كنت تقولين .) رواه البخاري৫১৪৭(
রবী বিনতে মুয়াওয়াজ রা. বর্ণনা করেন : যখন আমার বিবাহের অনুষ্ঠান হচ্ছিল তখন রাসূলুল্লাহ স. আমার কাছে এসে আমার বিছানায় এমনভাবে বসলেন যেমন তুমি বসেছ। তখন কয়েকজন বালিকা দফ বাজাচ্ছিল ও আমাদের পূর্ব-পুরুষদের যারা বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল তাদের প্রশংসামূলক সংগীত গাচ্ছিল। এ সংগীতের মাঝে এক বালিকা বলে উঠল ‘আমাদের মাঝে এমন এক নবী আছেন যিনি জানেন আগামী কাল কি হবে।’ তখন আল্লাহর রাসূল স. বললেন: ‘এ কথা বাদ দাও এবং যা বলছিলে তা বল।'[১২১]

(খ) ঈদের সময়ে। যেমন হাদিসে এসেছে,

عن عائشة رضى الله عنها قالت : دخل أبو بكر وعندي جاريتان من جواري الأنصار تغنيان بما تقاولت الأنصار يوم بعاث، قالت وليستا بمغنيتين، فقال أبو بكر : أمزامير الشيطان في بيت رسول الله ؟ وذلك يوم عيد، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : يا أبا بكر إن لكل قوم عيداً وهذا عيدنا (رواه البخاري ৯৫২)
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত একদিন আবু বকর রা. আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন দু জন আনসারী বালিকা বুয়াছ যুদ্ধে তাদের বীরত্ব সম্পর্কিত গান গাচ্ছিল, কিন্তু তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। আবু বকর রা. বললেন : ‘আশ্চর্য, আল্লাহর রাসূলের ঘরে শয়তানের বাদ্য !’ এদিনটা ছিল ঈদের দিন। আবু বকর রা.-এর কথা শুনে রাসূলুল্লাহ স. বললেন : ‘হে আবু বকর ! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এদিন হল আমাদের ঈদ।'[১২২]