ত্বাগূত’ নয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা ফায়ছালাই হল চূড়ান্ত ফায়ছালা

ত্বাগূত’ নয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা ফায়ছালাই হল চূড়ান্ত ফায়ছালা। আল্লাহ মানুষের স্রষ্টা। তিনিই সবচেয়ে ভাল জানেন কোথায় মানুষের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তাই কোন মানুষ আল্লাহর আইন ব্যতীত আল্লাহদ্রোহী ত্বাগূতের রচনা করা কোন আইনকে বিশ্বাস করতে পারে না, মানতেও পারে না।

ত্বাগূতের পরিচয় :

‘ত্বাগূত’ অর্থ- সীমালংঘনকারী, বিপদগামী, আল্লাহদ্রোহী, আল্লাহর বিধান লংঘনকারী নেতা, অবাধ্য, পথভ্রষ্ট, শয়তান, মূর্তি, দেবতা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) প্রদত্ত বিধানের অনুসরণ না করে মানব রচিত আইন বা শয়তানের অনুসরণ করাই হল ‘ত্বাগূত’।[1]

ত্বাগূতের প্রকারভেদ :

মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে ত্বাগূত পাঁচ প্রকার।[2] যেমন :

(ক) ইবলীস শয়তান। শয়তান ত্বাগূতদের প্রধান। সে মানুষকে ভ্রষ্টতা, কুফরী, ধর্মহীনতা ও জাহান্নামের দিকে আহবান করে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা কুফরী করে তাদের পৃষ্ঠপোষক হল ত্বাগূত। সে তার অনুসারীদেরকে হেদায়াত থেকে ভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যায়। মূলতঃ তারাই জাহান্নামের অধিবাসী, তারা চিরকাল সেখানে অবস্থান করবে’ (বাক্বারাহ ২৫৭)।

(খ) আল্লাহ ব্যতীত যার ইবাদত করা হয়। অথচ আল্লাহ বলেন, যারা ত্বাগূতের পূজা করে তাদের উপর তিনি অভিসম্পাত করেছেন (মায়েদাহ ৬০)।

(গ) যে ব্যক্তি গায়েবের খবর রাখে বলে দাবী করে। অথচ আল্লাহ ছাড়া কেউ গায়েব বা অদৃশ্যের খবর রাখে না। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুহাম্মাদ (ছাঃ)! আপনি বলুন, আল্লাহ ছাড়া আসমান ও যমীনের কেউই গায়েবের জ্ঞান রাখে না’ (নামল ৬৫)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমাকে বলবে যে, রাসূল (ছাঃ) গায়েব জানেন, তাহলে সে মিথ্যা বলবে’।[3]

(ঘ) যে ব্যক্তি জনগণকে তার ইবাদত করার জন্য আহবান জানায়। যেমন ছূফী ও মিথ্যা ত্বরীকাধারী পথভ্রষ্ট ফকীরেরা এই দাবী করে। তারা বলে, বাবার পূজা করলেই সবকিছু পাওয়া যায়। তারা মানুষের উপকার ও ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে। আল্লাহ বিধর্মীদের অবস্থা তুলে ধরে বলেন, ‘তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের আলেম ও ধর্ম যাজকদেরকে রব হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামের পুত্র মাসীহকেও গ্রহণ করেছে। অথচ তাদের প্রতি শুধু আদেশ করা হয়েছে যে, তারা একমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করবে, যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তারা যা অংশীদার স্থির করে, তা থেকে তিনি মহাপবিত্র’ (তওবা ৩১)।[4]

(ঙ) আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান প্রত্যাখ্যান করে যে ব্যক্তি মানব রচিত আইন দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে। আল্লাহ তাদের অবস্থা তুলে ধরে বলেন, ‘আপনি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করেননি, যারা মনে করে যে, আপনার প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা নাযিল করা হয়েছে, তার প্রতিও তারা বিশ্বাস করে- অথচ তারা তাদের ফায়ছালা ত্বাগূতের কাছে কামনা করে। যদিও তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন ত্বাগূতকে অস্বীকার করে। মূলতঃ শয়তান তাদেরকে দূরতম বিভ্রান্তিতে ফেলতে চায়’ (নিসা ৬০)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘যারা ঈমান আনয়ন করে তারা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে এবং যারা কুফরী করে তারা ত্বাগূতের রাস্তায় যুদ্ধ করে। অতএব তোমরা শয়তানের এজেন্টদের সাথে সংগ্রাম কর। নিশ্চয় শয়তানের কৌশল দুর্বল’ (নিসা ৭৬)।

উক্ত ত্বাগূতকে বর্জন করার জন্যই আল্লাহ প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক জনপদে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমরা প্রত্যেক উম্মতের মাঝে রাসূল পাঠিয়েছি এই জন্য যে, তারা যেন নির্দেশ দেন- তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূতকে বর্জন কর’ (নাহল ৩৬)।

দুঃখজনক হল, আমরা ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’-এর অর্থ যেমন বুঝি না, তেমনি ত্বাগূতের অর্থও বুঝি না। অথচ যতক্ষণ ত্বাগূত বা মানব রচিত মতবাদকে অস্বীকার না করা হবে, তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান না নেয়া হবে এবং তাকে উৎখাত ও প্রতিরোধ করার জন্য সংগ্রাম অব্যাহত না রাখা হবে, ততক্ষণ আল্লাহর একত্ব প্রমাণিত হবে না। সুতরাং প্রচলিত মা‘বূদগুলোকে আগে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করতে হবে, নাকচ করতে হবে। তারপর এক আল্লাহকে স্থান দিতে হবে। কারণ বিষের মধ্যে দুধ ঢেলে কোন লাভ নেই। অনুরূপ আলকাতরার মাঝে ঘি রেখেও কোন ফায়েদা নেই। এ জন্য ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’-এর অর্থ সে সময় মক্কার মূর্তিপূজারী মুশরিকরা বুঝেছিল। তাই তারা রাসূল (ছাঃ)-কে পাথর মেরেছিল।[5] তারা বুঝেছিল যে, এই বাক্য উচ্চারণ করলে বাপ-দাদার প্রতিষ্ঠিত জাহেলী যুগের ধর্ম আর চলবে না। সব বাতিল প্রমাণিত হবে।

বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ উক্ত বাক্য অনর্গল উচ্চারণ করে। কিন্তু গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন শিরকী ধর্ম ও মতবাদের আইন-কানূন, নিয়ম-নীতি ও আদর্শ মেনে চলে। অথচ এগুলো সবই ত্বাগূতী বিধান ও শিরকের শিখণ্ডী, যা রাজনীতির নামে চালু আছে। অনুরূপ ছূফীবাদী কুমন্ত্রণা, পীর-মুরীদী ধোঁকাবাজী, মারেফতী শয়তানী, মাযহাবী ফেতনা, তরীক্বার নষ্টামি, ইলিয়াসী ফযীলত ইত্যাদি মতবাদের নীতি-আদর্শ স্রেফ ধর্মের নামে লুকোচুরি। উপরিউক্ত উভয় প্রকার ত্বাগূতী ফায়ছালাকে যতক্ষণ অস্বীকার না করবে, ততক্ষণ কেউ আল্লাহ তা‘আলার শক্ত হাতলকে ধারণ করতে পারবে না (বাক্বারাহ ২৫৬)। অতএব ত্বাগূতকে অস্বীকার করা ছাড়া মুমিনের জন্য অন্য কোন পথ খোলা নেই।⁠⁠⁠⁠