রমজান মাসে বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করতে হয় কেন?

যারা ঈমানদার, তারা যখন আল্লাহর নাম নেয়, নরম হয় তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে কুরআন পাঠ করা হয়, তাদের ঈমান সজীব হয়ে ওঠে, তারা মওলার প্রেমে আত্মনিবেদিত হয়। (সুরা আনফাল : ২)
দুয়ার খুলেছে রহমতের। শুরু হলো রমজান। রহমতের উৎসব। রমজানের অবারিত রহমতে ভরে যাক আমাদের জীবন। যে কুরআনের প্রেমময়তায় আজ রমজান রহমতে ভরপুর, কুরআনের মুগ্ধতায় লাইলাতুল কদর হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ রাত! কুরআন এসেছিল বলে মক্কা-মদিনা পৃথিবীর মর্যাবান শহর! কুরআনের নবি হজরত মুহাম্মদ নবিদের সরদার! কুরআনের সেই প্রেম, মুগ্ধতা ও মর্যাদা আমাদের কতোাঁ আলোকিত করেছে?
মাস, রাত আর মক্কা-মদিনার মর্যাদা বাড়াতে কুরআন আসেনি পৃথিবীতে। কুরআন এসেছে মানুষের জীবন রাঙাতে। শুধু রাত শ্রেষ্ঠ হবে না; কুরআনের মানুষেরাও হবে আশরাফুল মাখলুকাত। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষ। কুরআন সে তো আল্লাহ প্রেমের চিঠি। পাঠে পাঠে সজীব হয় দেহমন। যোগায় আত্মিক শক্তিও। প্রেমের চিঠি প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালাও বলেন,
ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨُﻮﻥَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺇِﺫَﺍ ﺫُﻛِﺮَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻭَﺟِﻠَﺖْ ﻗُﻠُﻮﺑُﻬُﻢْ ﻭَﺇِﺫَﺍ ﺗُﻠِﻴَﺖْ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﺁﻳَﺎﺗُﻪُ ﺯَﺍﺩَﺗْﻬُﻢْ ﺇِﻳﻤَﺎﻧًﺎ ﻭَﻋَﻠَﻰ ﺭَﺑِّﻬِﻢْ ﻳَﺘَﻮَﻛَّﻠُﻮﻥَ
যারা ঈমানদার, তারা যখন আল্লাহর নাম নেয়, নরম হয় তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে কুরআন পাঠ করা হয়, তাদের ঈমান সজীব হয়ে ওঠে, তারা মওলার প্রেমে আত্মনিবেদিত হয়। (সুরা আনফাল : ২)
পবিত্র রমজানে পৃথিবীর ২৫ লাখ মসজিদে কুরআনুল কারিমের তেলাওয়াত হয়। এদেশের প্রায় ৫ লাখ মসজিদে তারাবির নামাজেও ভাব আবেগ ও মুগ্ধতায় পাঠ হয় পবিত্র কুরআন। হজরত রাসুল সা. বলেন,
ﻋﻦ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﺑﻦ ﻣﺴﻌﻮﺩ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﻗﺎﻝ : ﻗﺎﻝ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ : ( ﻣﻦ ﻗﺮﺃ ﺣﺮﻓﺎً ﻣﻦ ﻛﺘﺎﺏ ﺍﻟﻠﻪ ﻓﻠﻪ ﺑﻪ ﺣﺴﻨﺔ، ﻭﺍﻟﺤﺴﻨﺔ ﺑﻌﺸﺮ ﺃﻣﺜﺎﻟﻬﺎ، ﻻ ﺃﻗﻮﻝ : ﺍﻟﻢ ﺣﺮﻑ، ﻭﻟﻜﻦ ﺃﻟﻒ ﺣﺮﻑ، ﻭﻻﻡ ﺣﺮﻑ، ﻭﻣﻴﻢ ﺣﺮﻑ ).
অর্থ, কুরআন তেলাওয়াতকারী প্রতিটি বর্ণে দশটি সওয়াব পায়। আমি বলছি না, ‘আলিফ লাম মিম’ এর মধ্যে একটি অক্ষর। বরং আলিফ আলাদা, লাম আলাদা, মিম আলাদ বর্ণ। প্রতিটির জন্য ভিন্ন সওয়াব। (সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-৩০৭৫)
সওয়াবের নেশায় রাতজাগা চোখ-কান শুনবে তেলাওয়াত। বরাবরের মতো হাফেজ সাহেবরা কুরআন পাঠ করবেন। আমরা শুনবো। মনভরে উপভোগ করবো কুরআনের সুর। নেকি লাভ করবো। কিন্তু আমরা যদি কুরআনের চর্চায় আত্ম নিয়োগ করি। বিশুদ্ধ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে কুরআনের ভাব ভাষা অনুধাবন করি; দীর্ঘ জীবনে আমিও হয়ে ওঠতে পারি কুরআনের একজন ছাত্র। কুরআনের অলিগলি ভ্রমণকারী শিক্ষার্থী। আমাদের যাপিত জীবনে কুরআন হয়ে ওঠবে আরাধ্য।
কুরআনের উৎসবমুখর মাস রমজান। মানুষ হেদায়াতের প্রত্যাশায় মুখিয়ে থাকে। রমজানে মসজিদ ভরে যায় মুসল্লিতে। ফরজ নামাজ তো বটেই, তারাবি হয়ে ওঠে কুরআনের উৎসব। ইফতার উপলক্ষেও কানায় কানায় ভরে যায় মসজিদ। রোজার জুমায় মানুষের ঢল। কিয়ামুল লাইল বা শেষ রাতের তাহাজ্জুদেও মসজিদ প্রাণবন্ত থাকে। মসজিদমুখী মানুষেরা কুরআনের আলোয় জীবন রাঙাতে চায়। হেদায়াতের নেশায় ব্যাকুল মানুষেরা শুনতে চায় কুরআনের মর্মকথা। কুরআনের ইতিহাস ও গল্পে ফিরে যেতে চায় আগের নবি-রাসুলদের জীবনে। জান্নাতের হৃদয়কাড়া বর্ণনা ও জাহান্নামের ভয়াবহতা কুরআনের ভাষায় স্বাদ নিতে চায় মানুষেরা। কুরআনের পরিবার ও সমাজনীতি শিখতে চায় মুসল্লিরা। ইসলামের জীবন সৌন্দর্য্য কুরআনে কিভাবে আছে? আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনায় কুরআনের মনোভাব কী? এমনসব প্রশ্নের জবাব জানতে আগ্রহী মানুষেরা। আল্লাহর প্রেমে মজে থাকার এই প্রেমপত্র পাঠ করে বুঝতে চায় অভাগারা। কিন্তু কই? কে শোনাবে তাদের কুরআনের গল্প? কে দিবে কোটি পিপাসার্ত হৃদয়ে কুরআনের সবক?
দেশের প্রতিটি মসজিদে ইমাম-খতিব, বিজ্ঞ আলেম, মুফতি, মুফাসসিরগণ যদি মসজিদমুখী মানুষদের এই প্রত্যাশা পূরণে এগিয়ে আসতেন! সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি মানুষকে কুরআনের ছাত্রে পরিণত করতেন! প্রতিদিন তারাবির আগে-পরে বা অন্য কোনো সময় ধারাবাহিক বলতেন আজকের পঠিত আয়াতের তরজম-তাফসির বা কুরআনের বিশেষ আলোচনা! প্রতিদিন যদি বসতো কুরআনের উৎসব! মানুষ কুরআন চর্চায় অভ্যস্থ হয়ে উঠতো। যাপিত জীবনে আসতো কুরআনিক ছোঁয়া। জীবনে এমন কয়েকটি রমজান পেলে কুরআনময় হয়ে ওঠতো প্রতিটি মানুষের জীবন। রমজান শেষে মুসল্লিশূন্য হতো না মসজিদগুলো। কুরআনের পরশে বছরব্যাপী প্রাণবন্ত থাকতো মানুষের মন। কিন্তু কুরআনের কার্যকর প্রেম, ভালোবাসা, অর্থ ও মর্ম বোঝার গতি ক্রমেই কমে আসছে আমাদের জীবনে। শিল্পনন্দিত মুদ্রিত কুরআন বুকে নয়, আমরা সাজিয়ে রাখি শোকেসে। মাঝে-মধ্যে চুমো খেয়ে সম্মান জানাই। এমনও হয়, শ্রদ্ধাভরে ঘরের কুরআনটি পাঠিয়ে দিই মসজিদে। বাসা-বাড়িতে এত সামগ্রীর ভিড়ে কুরআন রাখবো কোথায়! ওই আদুরে ছেলের মতো, যে মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, বাসায় তোমার কষ্ট হয়, বৃদ্ধাশ্রম ভালো লাগবে। বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমের জীবন্ত কবরে পাঠিয়ে ছেলে যে তৃপ্তি পায়, ঘরের কুরআন মসজিদে পাঠিয়েও আমাদের সে রকম উপলব্ধি। সত্যিই কুরআনের মর্মকথা আমরা বুঝি না। খুব সহজে রঙিন মোড়কে আমরা কুরআন পেয়েছি বলে। বুখারি শরিফে আছে-
ﻗﺎﻝ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﺑﻦ ﻋﺒﺎﺱ ﻛﻨﺖ ﺃﻧﺎ ﻭﺟﺎﺭ ﻟﻲ ﻣﻦ ﺍﻷﻧﺼﺎﺭ ﻓﻲ ﺑﻨﻲ ﺃﻣﻴﺔ ﺑﻦ ﺯﻳﺪ ﻭﻫﻢ ﻣﻦ ﻋﻮﺍﻟﻲ ﺍﻟﻤﺪﻳﻨﺔ ﻭﻛﻨﺎ ﻧﺘﻨﺎﻭﺏ ﺍﻟﻨﺰﻭﻝ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭ ﺳﻠﻢ ﻓﻴﻨﺰﻝ ﻳﻮﻣﺎ ﻭﺃﻧﺰﻝ ﺃﻧﺎ ﻓﺈﺫﺍ ﻧﺰﻟﺖ ﺟﺌﺘﻪ ﺑﻤﺎ ﺣﺪﺙ ﻣﻦ ﺧﺒﺮ ﺫﻟﻚ ﺍﻟﻴﻮﻡ ﻣﻦ ﻭﺣﻲ ﺃﻭ ﻏﻴﺮﻩ ﻭﺇﺫﺍ ﻧﺰﻝ ﻓﻌﻞ ﻣﺜﻞ ﺫﻟﻚ
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, বনু উম্মায়ার আনসারী প্রতিবেশী ও আমি কুরআনের আয়াতের জন্য পালা বদল করে নবিজির দরবারে আসা যাওয়া করতাম। এমন হতো, একদিন আমি যেতাম, আরেক দিন তিনি। আমরা নবিজির দরবার থেকে শুনে আসা কুরআন পরস্পর শোনাতাম।
একটি আয়াতের জন্য সাহাবির দিনের পর দিন পথে অপেক্ষার কষ্ট আমরা কি অনুভব করতে পারব?
আল্লাহ বলেন,
ﻛِﺘَﺎﺏٌ ﺃَﻧْﺰَﻟْﻨَﺎﻩُ ﺇِﻟَﻴْﻚَ ﻣُﺒَﺎﺭَﻙٌ ﻟِﻴَﺪَّﺑَّﺮُﻭﺍ ﺁﻳَﺎﺗِﻪِ ﻭَﻟِﻴَﺘَﺬَﻛَّﺮَ ﺃُﻭﻟُﻮ ﺍﻟْﺄَﻟْﺒَﺎﺏِ
এক কল্যাণময় কিতাব আমি অবতীর্ণ করেছি। যাতে মানুষ কুরআন অনুভব করে। বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা তা উপদেশ হিসেবে গ্রহণ করে। (সুরা সদ : ২৯)
————————–————————–—-
• Present by – Bayzid Bin Osman