হাদীছের গল্প

আয়েশা (রাঃ)-এর প্রতি অপবাদের ঘটনা:-

কপটতা মানব মনের এক দুষ্টু ক্ষত। এর ফলে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হয়। কখনো এর ফলে নিরপরাধ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুনাফিক্ব সরদার আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনে সুলূলের মুনাফিক্বীর শিকার হয়েছিলেন নবীপত্নী নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারিণী মা আয়েশা (রাঃ)। যে কারণে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা অহি-র মাধ্যমে আয়েশা (রাঃ)-এর পবিত্রতার কথা ঘোষণা করেন। আয়েশা (রাঃ)-এর প্রতি আরোপিত অপবাদ সম্পর্কেই আলোচ্য হাদীছ।-
উরওয়াহ ইবনু যুবায়ের, সা‘ঈদ ইবনু মুসায়্যিব, আলক্বামাহ ইবনু ওয়াক্কাস ও ওবায়দুল্লাহ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু উতবাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সহধর্মিণী আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, … তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন সফরে যেতে ইচ্ছা করতেন, তখন তিনি তাঁর স্ত্রীগণের মধ্যে (নির্বাচনের জন্য) লটারী করতেন। এতে যার নাম উঠত তাকেই তিনি সঙ্গে নিয়ে সফরে যেতেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এমনি এক যুদ্ধে তিনি আমাদের মাঝে লটারী করেন, এতে আমার নাম উঠে আসে। তাই আমিই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে সফরে গেলাম। এ ঘটনাটি পর্দার হুকুম নাযিলের পর ঘটেছিল। তখন আমাকে হাওদাসহ সওয়ারীতে উঠানো ও নামানো হ’ত। এমনিভাবে আমরা চলতে থাকলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন এ যুদ্ধ থেকে নিষ্কৃতি লাভ করলেন, তখন তিনি (গৃহাভিমুখে) প্রত্যাবর্তন করলেন। ফেরার পথে আমরা মদীনার নিকটবর্তী হ’লে তিনি একদিন রাতের বেলা রওয়ানা হওয়ার জন্য আদেশ করলেন। রওয়ানা হওয়ার ঘোষণা দেয়া হ’লে আমি উঠলাম এবং (প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য) পায়ে হেঁটে সেনাছাউনী পেরিয়ে (সামনে) গেলাম। অতঃপর প্রয়োজন সেরে আমি আমার সওয়ারীর কাছে ফিরে এসে বুকে হাত দিয়ে দেখলাম যে, (ইয়ামনের অন্তর্গত) যিফার শহরের পুঁতি দ্বারা তৈরি করা আমার গলার হারটি ছিঁড়ে কোথায় পড়ে গেছে। তাই আমি ফিরে গিয়ে আমার হারটি খোঁজতে লাগলাম। হার খুঁজতে খুঁজতে আমার আসতে দেরী হয়ে যায়। আয়েশা (রাঃ) বলেন, যে সমস্ত লোক উটের পিঠে আমাকে উঠিয়ে দিতেন তারা এসে আমার হাওদা উটের পিঠে উঠিয়ে দিলেন। তারা ভেবেছিলেন, আমি হাওদার মধ্যেই আছি। কারণ খাদ্যাভাবে মহিলারা তখন খুবই হালকা হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের দেহ মাংসল ছিল না। তারা খুবই স্বল্প পরিমাণ খানা খেতে পেত। তাই তারা যখন হাওদা উঠিয়ে উপরে রাখেন, তখন তারা হালকা হাওদাটিকে কোন প্রকার অস্বাভাবিক মনে করেননি। অধিকন্তু আমি ছিলাম একজন অল্প বয়স্কা কিশোরী। এরপর তারা উট হাঁকিয়ে নিয়ে চলে যায়। সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর আমি আমার হারটি খুঁজে পাই এবং নিজ জায়গায় ফিরে এসে দেখি তাদের (সৈন্যদের) কোন আহবানকারী এবং কোন জওয়াব দাতা সেখানে নেই। তখন আমি আগে যেখানে ছিলাম সেখানে বসে রইলাম। ভাবলাম, তারা আমাকে দেখতে না পেয়ে অবশ্যই আমার কাছে ফিরে আসবে। ঐ স্থানে বসে থাকা অবস্থায় ঘুম চেপে ধরলে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। বনু সুলামী গোত্রের যাকওয়ান শাখার ছাফওয়ান ইবনু মু‘আত্তাল (রাঃ) (যাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফেলে যাওয়া আসবাবপত্র সংগ্রহের জন্য পশ্চাতে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন) সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর সেখানে ছিলেন। তিনি সকালে আমার অবস্থানস্থলের কাছে এসে একজন ঘুমন্ত মানুষ দেখে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে চিনে ফেললেন। পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। তিনি আমাকে চিনতে পেরে ‘ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন’ পড়লে আমি তা শুনে জেগে উঠলাম এবং চাদর টেনে আমার চেহারা ঢেকে ফেললাম। আল্লাহর কসম! আমি কোন কথা বলিনি এবং তাঁর থেকে ইন্না লিল্লাহ… পাঠ ব্যতীত অন্য কোন কথাও শুনতে পাইনি। এরপর তিনি সওয়ারী থেকে নামলেন এবং সওয়ারীকে বসিয়ে তার সামনের পা নিচু করে দিলে আমি গিয়ে তাতে উঠে পড়লাম। পরে তিনি আমাকে সহ সওয়ারীকে টেনে আগে আগে চললেন।

অতঃপর ঠিক দুপুরে প্রচন্ড গরমের সময় আমরা গিয়ে সেনাদলের সঙ্গে মিলিত হ’লাম। সে সময় তাঁরা একটি জায়গায় অবতরণ করছিলেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এরপর যাদের ধ্বংস হওয়ার ছিল, তারা (আমার উপর অপবাদ দিয়ে) ধ্বংস হয়ে গেল। তাদের মধ্যে এ অপবাদ দেয়ার ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল সে হচ্ছে আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনে সুলূল।
উরওয়াহ (রাঃ) বলেন, আমি জানতে পেরেছি যে, তার (আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনে সুলূল) সামনে অপবাদের কথাগুলো প্রচার করা হ’ত এবং আলোচনা করা হ’ত, আর অমনি সে এগুলোকে বিশ্বাস করত। সে খুব ভাল করে শুনত আর শোনা কথার ভিত্তিতেই ব্যাপারটিকে প্রমাণ করার চেষ্টা করত। উরওয়াহ (রাঃ) আরো বর্ণনা করেছেন যে, অপবাদ আরোপকারী ব্যক্তিদের মধ্যে হাসসান বিন ছাবিত, মিসতাহ ইবনু উছাছা এবং হামনা বিনতু জাহশ (রাঃ) ব্যতীত আর কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। তারা কয়েকজন লোকের একটি দল ছিল। এটুকু ব্যতীত তাদের ব্যাপারে আমার আর কিছু জানা নেই। যেমনটি (আল-কুরআনে) মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন। এ ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তাকে আবদুল্লাহ ইবনু উবাই বিন সুলূল বলে ডাকা হয়ে থাকে। উরওয়াহ (রাঃ) বলেন, আয়েশা (রাঃ) এ ব্যাপারে হাসসান বিন ছাবিত (রাঃ)-কে গালমন্দ করাকে পসন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, হাসসান বিন ছাবিত (রাঃ) তো সেই লোক, যিনি তার এক কবিতায় বলেছেন,
فَإِنَّ أَبِىْ وَوَالِدَهُ وعِرْضِىْ لِعِرْضِ مُحَمَّدٍ مِنْكُمْ وِقَاءُ
আমার মান-সম্মান এবং আমার বাপ-দাদা
মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মান-সম্মান রক্ষায় নিবেদিত।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, অতঃপর আমরা মদীনায় আসলাম। মদীনায় এসে এক মাস পর্যন্ত আমি অসুস্থ থাকলাম। এদিকে অপবাদ রটনাকারীদের কথা নিয়ে লোকেদের মধ্যে আলোচনা ও চর্চা হ’তে থাকল। কিন্তু এগুলোর কিছুই আমি জানি না। তবে আমি সন্দেহ করছিলাম এবং তা আরো দৃঢ় হচ্ছিল আমার এ অসুখের সময়। কেননা এর আগে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে যে রকম স্নেহ-ভালবাসা পেতাম, আমার এ অসুখের সময় তা আমি পাচ্ছিলাম না। তিনি আমার কাছে এসে সালাম করে কেবল ‘তুমি কেমন আছ’ জিজ্ঞেস করে চলে যেতেন। তাঁর এ আচরণই আমার মনে ভীষণ সন্দেহ জাগিয়ে তোলে। তবে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাইরে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত এ জঘন্য অপবাদের ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। উম্মু মিসতাহ (রাঃ) (মিসতাহর মা) একদা আমার সঙ্গে পায়খানার দিকে বের হন। আর প্রকৃতির ডাকে আমাদের বের হওয়ার অবস্থা এই ছিল যে, এক রাতে বের হ’লে আমরা আবার পরের রাতে বের হ’তাম। এটা ছিল আমাদের ঘরের পার্শ্বে পায়খানা তৈরি করার আগের ঘটনা। আমাদের অবস্থা প্রাচীন আরবের লোকদের মতো ছিল। তাদের মতো আমরাও প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার জন্য ঝোপঝাড়ে চলে যেতাম। এমনকি (অভ্যাস না থাকায়) বাড়ির পার্শ্বে পায়খানা তৈরি করলে আমরা খুব কষ্ট পেতাম। আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা আমি এবং উম্মু মিসতাহ (যিনি ছিলেন আবু রূহম ইবনে মুত্তালিব ইবনে আবদে মুনাফের কন্যা, যার মা সাখার ইবনু আমির-এর কন্যা ও আবূবকর ছিদ্দীকের খালা এবং মিসতাহ ইবনু উছাছা ইবনু আববাদ ইবনে মুত্তালিব যার পুত্র) একত্রে বের হ’লাম। আমরা আমাদের প্রয়োজন সেরে বাড়ি ফেরার পথে উম্মু মিসতাহ তার কাপড়ে জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে বললেন, মিসতাহ ধ্বংস হোক। আমি তাকে বললাম, আপনি খুব খারাপ কথা বললেন। আপনি কি বদর যুদ্ধে যোগদানকারী ব্যক্তিকে গালি দিচ্ছেন? তিনি আমাকে বললেন, ওগো অবলা! সে তোমার সম্বন্ধে কি কথা বলে বেড়াচ্ছে তুমি তো তা শোননি? আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, সে আমার সম্পর্কে কি বলছে? তখন তিনি অপবাদ রটনাকারীদের কথাবার্তা সম্পর্কে আমাকে জানালেন। আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, এরপর আমার পুরানো রোগ আরো বেড়ে গেল। আমি বাড়ি ফেরার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার কাছে আসলেন এবং সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেমন আছ? আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি আমার পিতা-মাতার কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক খবর জানতে চাচ্ছিলাম, তাই আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললাম, আপনি কি আমাকে আমার পিতা-মাতার কাছে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিবেন? আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে অনুমতি দিলেন। তখন আমি আমার আম্মাকে বললাম, আম্মাজান, লোকজন কি আলোচনা করছে? তিনি বললেন, বেটী এ ব্যাপারটিকে হালকা করে ফেল। আল্লাহর কসম! সতীন আছে এমন স্বামীর সোহাগ লাভে ধন্যা সুন্দরী রমণীকে তাঁর সতীনরা বদনাম করবে না, এমন খুব কমই হয়। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, সুবহানাল্লাহ। লোকজন কি এমন গুজবই রটিয়েছে? আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, সারারাত আমি কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে সকাল হয়ে গেল। এর মধ্যে আমার চোখের পানিও বন্ধ হ’ল না এবং আমি ঘুমাতেও পারলাম না। এরপর ভোরবেলাও আমি কাঁদছিলাম। তিনি আরো বলেন যে, এ সময় অহী নাযিল হ’তে দেরি হওয়ায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর স্ত্রীর (আমার) বিচ্ছেদের বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ ও আলোচনা করার নিমিত্তে আলী ইবনু আবু ত্বালিব এবং উসামাহ ইবনু যায়েদ (রাঃ)-কে ডেকে পাঠালেন।

তিনি [আয়েশা (রাঃ)] বলেন, উসামাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের পবিত্রতা এবং তাদের প্রতি (নবী করীম (ছাঃ)-এর) ভালবাসার কারণে বললেন, তাঁরা আপনার স্ত্রী, তাঁদের সম্পর্কে আমি ভাল ব্যতীত আর কিছুই জানি না। আলী (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আল্লাহ তো আপনার জন্য সংকীর্ণতা রাখেননি। তিনি ব্যতীত আরো বহু মহিলা আছে। অবশ্য আপনি এ ব্যাপারে দাসী [বারীরাহ (রাঃ)]-কে জিজ্ঞেস করুন। সে আপনার কাছে সত্য কথাই বলবে। আয়েশা (রাঃ) বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বারীরাহ (রাঃ)-কে ডেকে বললেন, হে বারীরাহ! তুমি তাঁর মধ্যে কোন সন্দেহপূর্ণ আচরণ দেখেছ কি? বারীরাহ (রাঃ) বললেন, ঐ আল্লাহর শপথ! যিনি আপনাকে সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন, আমি তাঁর মধ্যে কখনো এমন কিছু দেখিনি, যার দ্বারা তাঁকে দোষী বলা যায়। তবে তাঁর সম্পর্কে কেবল এটুকু বলা যায় যে, তিনি হ’লেন অল্প বয়স্কা কিশোরী। রুটি তৈরী করার জন্য আটা খামির করে রেখে ঘুমিয়ে পড়েন আর বকরী এসে অমনি তা খেয়ে ফেলে।
তিনি [আয়েশা (রাঃ)] বলেন, সেদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে মিম্বরে বসে আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই-এর ক্ষতি থেকে রক্ষার আহবান জানিয়ে বললেন, হে মুসলিম সম্প্রদায়! যে আমার স্ত্রীর ব্যাপারে অপবাদ রটিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়েছে তার এ অপবাদ থেকে আমাকে কে মুক্ত করবে? আল্লাহর কসম! আমি আমার স্ত্রী সম্পর্কে ভাল ব্যতীত আর কিছুই জানি না। আর তারা এক ব্যক্তির (ছাফওয়ান ইবনু মু‘আত্তাল) নাম উল্লেখ করছে, যার ব্যাপারেও আমি ভাল ব্যতীত কিছু জানি না। সে তো আমার সঙ্গেই আমার ঘরে যায়।