সালাফী মতাদর্শ কী?

সালাফী মতাদর্শ কী?

মূল: আল্লামা শাইখ মুহাম্মদ নাসির উদ্দীন আলবানী রহ.

অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

********************************************

প্রশ্ন: সালাফী মতাদর্শ কী এবং তা কিসের সাথে সম্পৃক্ত?

উত্তর: সালাফী মতাদর্শ বলতে বুঝায় পূর্বসূরীদের মূলনীতি ও আদর্শ। এটি সম্পৃক্ত সালাফ তথা পূর্বসূরীদের সাথে।

সুতরাং আলেমগণ কী অর্থে ‘সালাফ’ শব্দ ব্যবহার করেন তা আমাদের জানা আবশ্যক। তাহলে বুঝা যাবে সালাফী কাকে বলে বা সালাফী শব্দের মর্ম কি।

‘সালাফ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল এমন তিন শতাব্দির ব্যক্তিবর্গ যাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই উম্মতের শ্রেষ্ঠতম মানুষ হিসেবে স্বাক্ষ্য প্রদান করেছেন। যেমন বুখারী ও মুসলিম সহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে মুতাওয়াতির সূত্রে একদল সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে,

خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي ، ثُمَّ الَّذيِنَ يَلُونَهُمْ ، ثُمَّ الَّذيِنَ يَلُونَهُمْ

“সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ হল, আমার যুগের মানুষ অত:পর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ অত:পর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ।” (বুখারী ও মুসলিম)

এই তিন যুগের মানুষকে আল্লার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে স্বাক্ষ্য প্রদান করেছেন। ‌আর সালাফীগণ এই পূর্বসুরীদের সাথে সম্পৃক্ত।

আমরা সালাফ শব্দের অর্থ জানতে পারলাম। এবার আমি দুটি বিষয় বলব:

প্রথম বিষয়, মুসলিম বিশ্বে বর্তমানে বিভিন্ন জামায়াত বা দলের মত সালাফী আন্দোলন কোন এক বা একাধিক ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত নয়। বরং এই সম্পৃক্ততা হল পবিত্র ও নিষ্কলুষ একটি আদর্শের সাথে। কারণ, পূর্বসুরীগণ সম্মিলিতভাবে গোমরাহীর উপর থাকবেন-এটা সম্ভবপর নয়। পক্ষান্তরে পরবর্তীত যুগের মানুষের ব্যাপারে শরীয়তে প্রশংসা বর্ণিত হয় নি। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের নিন্দাবাদ বর্ণিত হয়েছে। যেমনটি পূবোর্ক্ত হাদীসের শেষাংশে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইঙ্গিত করে বলেছেন:

ثُمَّ يأتي مِن بعدِهِم أقوامٌ يَشْهَدُون ولا يُسْتَشْهَدُون إلى آخر الحديث

“এরপর তাদের পরে এমন সব মানুষের আবির্ভাব ঘটবে যারা স্বাক্ষ্য দিবে কিন্তু তাদের নিকট স্বাক্ষ্য চাওয়া হবে না।” তিনি অন্য আরেক হাদীসেও এ ইঙ্গিত দিয়েছেন। উক্ত হাদীসের আলোকে বুঝা যায় যে, তিনি সেখানে মুসলিমদের একটি দলের প্রশংসা এবং ‘অধিকাংশ’ লোকের নিন্দা করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

ُلَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ ِ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَالَفَهُمْ حَتَّى يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللَّهِأَوْ حَتّى تَقُوْمَ السَّاعَة

“আমার উম্মতের একটি দল সত্যের উপর বিজয়ী থাকবে। বিরোধীতাকারীরা আল্লাহর হুকুম আসা পর্যন্ত তথা কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।” এই হাদীসে শেষ জামানার একটি দলের বিশেষভাবে প্রশংসা করা হয়েছে। আরবীطَائِفَةٌ শব্দের মানে হল, একটি ছোট জামায়াত বা দল। আভিধানিক অর্থে এক বা একাধিক ব্যক্তি বুঝাতে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

অত:এব যখন আমরা সালাফিয়াতের অর্থ জানলাম, আরও জানলাম যে সালাফীগণ পূর্বসূরীদের সাথে সম্পৃক্ত এবং কোন মুসলিম যদি এই পূর্বসূরীদের আদর্শকে গ্রহণ করে তবে সেটাই সব চেয়ে নিরাপদ তখন কোন ব্যক্তি সালাফী ছাড়া অন্য অন্য কিছু হতে পারে না; সম্ভব নয়। কারণ, সালাফিয়াতের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার অর্থ হল এক নিরাপদ, নিষ্কলুশ এবং পবিত্র নীতি ও আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া।

এই নিষ্কলুষ নীতি ও আদর্শকে আমরা কোথা থেকে গ্রহণ করলাম? আমরা এটি গ্রহণ করলাম একটি হাদীস থেকে-যে হাদীসটিকে পরবর্তীকালের মানুষেরা একটি ভুল অর্থে দলীল হিসেবে ব্যবহার করে। তা হল, এরা এ হাদীস দ্বারা প্রমাণ পেশ করতে চায় যে, পরবর্তীকালের অধিকাংশ মানুষ যে মত গ্রহণ করবে সেটাকেই হুজ্জত বা দলীল হিসেব গণ্য হবে।’

অথচ لا تجتمع أمتي على ضلالة “আমার উম্মত গোমরাহীর উপরে একমত হবে না” হাদীসটিকে বর্তমান মুসলামানদের উপর প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। বর্তমানে মুসলমানদের দূরাবস্থা সম্পর্কে যারা খোঁজ-খবর রাখেন তাদের সকলেই এটা জানেন। তাছাড়াও একাধিক সহীহ হাদীস রয়েছে যেগুলোতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পূর্বে ইহুদী-খৃষ্টানদের দলে দলে বিভক্ত হওয়া এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পরে মুসলিমদের মাঝে মতপার্থক্য সৃষ্টি হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“ইহুদীরা একাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল, খৃষ্টানরা বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল আর আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। এগুলোর মধ্যে এক দল ছাড়া সব জাহান্নাম যাবে। সাহাবীগণ বললেন:

সেটি কোন দল হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, সেটি ‘আল জামাআহ’।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ঐ সকল পূর্বসূরীদের বিরোধিতা করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা:

وَمَن يُشَاقِقِ الرَّ‌سُولَ مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَىٰ وَيَتَّبِعْ غَيْرَ‌ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرً‌ا

“যার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পরও রসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে এবং ঈমানদারদের অনুসৃত পথ ছাড়া ভিন্ন পথ অবলম্বন করবে,আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাব যে দিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান।” (সূরা নিসা: ১১৫)

আমি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার ভাইদেরকে এ দিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি যে, আল্লাহ তায়ালা কেন রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করা’ এর সাথে ঈমানদারদের অনুসৃত পথ ছাড়া অন্য পথ অবলম্বন করা’র কথা সংযোজন করলেন? এর রহস্য কী? অথচ এ বাক্যটি উহ্য করে দিলেও উপরোক্ত আয়াতটি রাসূলের বিরুদ্ধাচারণকারীদের কুপরিণতী ও সতর্কবার্তা ও হিসেবে যথেষ্ট হত।

কিন্তু আয়াতটি এমন নয় বরং এখানে সংযোজন করা হয়েছে “ঈমানদারদের অনুসৃত পথ ছাড়া অন্য পথ অবলম্বন করবে” এটা কি অনর্থক? আল্লাহর বাণী অনর্থক হতে পারে না। তাহলে এ আয়াতের অর্থ হল, যে ব্যক্তি সাহাবীদের অনুসৃত পথ (আমরা যাকে বলেছি সব চেয়ে নিরাপদ ও নিষ্কুলশ আদর্শ) এর পথ ছেড়ে ভিন্ন পথ গ্রহণ করবে তাদের পরিণতী হবে জাহান্নাম।

সাহাবীগণই হল ‘আল জামাআ’-যাদের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বাক্ষ্য দিয়েছে যে, তারা এবং তাদের অনুগামীরা হল, ‘মুক্তিপ্রাপ্ত দল’। যারা কিয়ামতের দিন জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচতে চায় তাদের জন্য এই সাহাবী ও তাঁদের অনুসারীদের পথের বিরোধিতা করা বৈধ নয়। এই কারণেই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

“যার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পরও রসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে এবং ঈমানদারদের অনুসৃত পথ ছাড়া ভিন্ন পথ অবলম্বন করবে, আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাব যে দিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান।”

সুতরাং বর্তমান যুগের মুসলিমদের দুটি জিনিস জানা জরুরি। যথা:

প্রথমত: উক্ত আয়াতে উল্লেখিত ঈমানদারগণ কারা?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কুরআন, হাদীস সরাসরি শোনার হেকমত কী? তাছাড়া একমাত্র তারাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কুরআন-সুন্নাহর দলীলগুলোকে কর্মে বাস্তবায়ন করতে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।

একটি হকমত হল, যেমনটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “লোক মারফতে কোন খবর জানা আর স্বচক্ষে দেখা এক সমান নয়।” এ হাদীসের আলোকে (আরবী) কবি বলেছেন: (অর্থ)

“যে শুনেছে সে ঐ ব্যক্তির মত নয় যে নিজ চোখে দেখেছে।”

সুতরাং যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে নি তারা ঐ সকল সাহাবীদের মত হতে পারে না যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন, তাঁর নিকট থেকে সরাসরি হাদীস শুনেছেন এবং তাঁকে কুরআন-সুন্নাহকে কর্মে বাস্তবায়িত করতে দেখেছেন।

বর্তমানে কতিপয় দাঈর নিকট একটা আধুনিক কথা শোনা যাচ্ছে। কথাটি খুব সুন্দর। কিন্তু এর চেয়ে সুন্দর হত যদি তা আমরা বাস্তব প্রমাণিত করতে পারতাম। এই দাঈগণ তাদের আলোচনা, বক্তৃতা, ওয়াজ মাহফিল ইত্যাদিতে বলে থাকেন যে, “ইসলামকে পৃথিবীতে চলমান বাস্তবতায় প্রমাণিত করা অপরিহার্য।” খুব সুন্দর কথা! কিন্তু আমরা যদি আমাদের পূর্বসুরীদের বুঝের আলোকে ইসলাম বুঝতে না পারি তবে এ কথাকে পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে না। যারা তা বাস্তবায়িত করেছিলেন তারা হলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবীগণ। এর কারণ হল পূবোর্ক্ত দুটি কারণ। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সরাসরি কথা শুনে সেগুলোকে সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করেছেন। তাছাড়া কতগুলো বিষয় আছে যেগুলো কর্মগতভাবে ব্যাখ্যার প্রয়োজন। তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ বিষয়গুলো কাজে বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যাখ্যা দিতে দেখেছেন।

আমি আপনাদেরকে একটি অত্যন্ত স্পষ্ট উদাহরণ দিচ্ছি। কুরআনে এমন কিছু আয়াত আছে যেগুলোর ব্যাখ্যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত না জানা পর্যন্ত কোন মুসলিমের বোঝা সম্ভব নয়। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ‌ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ

“আমি তোমার কাছে উপদেশ বাণী নাজিল করেছি যাতে তুমি তাদের কাছে নাজিলকৃত বিষয়গুলো ব্যাখ্যা কর।”” (সূরা নাহল: ৪৪)

বর্তমান যুগের আরবী ভাষার পণ্ডিত কাউকে নিয়ে এসে এই আয়াতের তাফসীর করতে দিন। চোর কে? ভাষাগতভাবে চোরের সঙ্গা দেয়া সম্ভব নয়। আর হাত? হাত কাকে বলে? শেষ জমানার সবচেয়ে বড় ভাষাবিদও এই দুই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। সে চোর কে যার হাত কাটার উপযুক্ত? আর সেটা কোন হাত যা এই চুরির অপরাধে কাটা হবে?

ভাষাগতভাবে যে একটি ডিম চুরি করে সেও চোর। আর হাতের কোন অংশ কাটা হবে? হাতের এখানে কাটা হোক বা ওখানে কাটা হোক বা অন্য যে কোন স্থানেই কাটা হোক সেটা তো হাতই।

সুতরাং উত্তর হল,এ বিষয়গুলো ব্যাখ্যার জন্য অবশ্যই আমাদেরকে রাসূল এর সুন্নতের কাছে যেতে হবে। স্বরণ করুন উপরোক্ত আয়াত যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ

“আমি তোমার কাছে উপদেশ বাণী নাজিল করেছি যাতে তুমি তাদের কাছে নাজিলকৃত বিষয়গুলো ব্যাখ্যা কর।” (সূরা নাহল: ৪৪)।

সুতরাং উপরোক্ত প্রশ্নোগুলোর উত্তর রয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ব্যাখ্যায়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। আর তাঁর এ ব্যাখ্যাগুলোই ইসলাম বাস্তবে রূপায়িত করেছে। বিশেষ করে এটি এবং আরও অন্যান্য আয়াত। এগুলোর সংখ্যা অনেক। কেননা, যে ব্যক্তি ইলমে উসূল পড়েছে সে জানে যে, ইলমে উসূলে আম খাস, মুতলাক, মুকাইয়াদ, নাসিখ-মানসূখ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় আছে।

(আল্লামা আলবানী রহ.  এর বক্তৃতা থেকে নেয়া)

উৎস: শাইখ আলবানীর রহ. এর ওয়েব সাইট।