সবর : মুমিনের বিপদে সান্ত্বনার পরশ

সবর : মুমিনের বিপদে সান্ত্বনার পরশ

শিব্বীর আহমদ

বিচিত্র এই পৃথিবীতে কত রকম মানুষের বাস। কেউ সাদা কেউ কালো, কেউ ধনী কেউ গরীব, কেউ লম্বা কেউ খাটো, কেউ শাসক কেউ শাসিত, আরও কত কী! এই বৈচিত্র্যের মাঝেও ঐক্যের সুর- সুখ-দুঃখ মিলিয়েই মানুষের জীবন। ঘরবাড়ি নেই বলে রাস্তার পাশে ফুটপাথে যাকে মাথা গুজার ঠাঁই খুঁজতে হয় তার জীবনেও যেমন সুখের পরশ থাকে, তেমনি উঁচু উঁচু অট্টালিকায় যাদের বসবাস, কাড়ি কাড়ি সম্পদের অধিকারী যারা তারাও কখনো নীল হয়ে পড়ে দুঃখ-বেদনায়। দুঃখ-বেদনা বিপদ আর কষ্টের ধরনও অনেক। শরীর মন অর্থসম্পদ সম্মান-ঐতিহ্য ইত্যাদি কত দিক থেকে মানুষ বিপদের মুখে পড়ে। কেউ হয়তো শারীরিকভাবে অসুস্থ, কাউকে দেখা যাবে পারিবারিক কারণে গভীর দুশ্চিন্তার শিকার, কারও দীর্ঘদিনের অর্জন সামাজিক সম্মানটুকু কখনো মুহূর্তে ধুলোয় মিশে যায়। এ সবই মানুষের বিপদ। মানুষের জীবনে বিপদ আসবেই। আল্লাহ তাআলার কেমন দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা-

وَ لَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَیْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَ الْجُوْعِ وَ نَقْصٍ مِّنَ الْاَمْوَالِ وَ الْاَنْفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیْنَ.

আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব (কখনও) ভয়-ভীতি, (কখনও) ক্ষুধা দ্বারা এবং (কখনও) জানমাল ও ফলফসলের ক্ষয়-ক্ষতি দ্বারা, আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। -সূরা বাকারা (২) : ১৫৫

আরেক আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিনের ঘোষণা-

لَتُبْلَوُنَّ فِیْۤ اَمْوَالِكُمْ وَ اَنْفُسِكُمْ وَ لَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَ مِنَ الَّذِیْنَ اَشْرَكُوْۤا اَذًی كَثِیْرًا وَ اِنْ تَصْبِرُوْا وَ تَتَّقُوْا فَاِنَّ ذٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْاُمُوْرِ.

তোমরা তোমাদের জান-মালের ক্ষেত্রে অবশ্যই পরীক্ষার মুখোমুখি হবে আর তোমরা আহলে কিতাব ও মুশরিকদের পক্ষ থেকে অনেক পীড়াদায়ক কথা শুনবে। তোমরা যদি সবর ও তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে অবশ্যই তা বড় হিম্মতের কাজ। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৮৬

বোঝা গেল, বিপদ আসবেই। পবিত্র কুরআনের এ দ্ব্যর্থহীন ঘোষণায় তো সন্দেহের অবকাশ নেই। পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে জীবনের নানা ক্ষেত্রে, নানা ধরনে। সেই পরীক্ষায় সফল হওয়ার মূলমন্ত্রও ঘোষিত হয়েছে পাক কুরআনেই। সফলতার সেই মূলমন্ত্রের নামই সবর বা ধৈর্যধারণ। বিপদ যেমনই হোক, বিপদ তো বিপদই। কেউ যখন বিপদে পড়ে, তা ছোট-বড় যাই হোক, সে বিপদের মর্ম সে-ই বুঝে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি যদি কোনো দুর্ঘটনায় আকস্মিক মৃত্যুবরণ করে তাহলে তার পরিবারের জন্যে তা যেমন মহাবিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি নামায শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে পুরনো জুতাটি জায়গামতো না পাওয়াও একটি বিপদ। প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয়টি নগণ্য, কিন্তু সময়মতো এই এক জোড়া পুরনো জুতা না পাওয়া যে কত সংকটের সৃষ্টি করতে পারে তা ভুক্তভোগীই অনুভব করতে পারেন। ছোট-বড় সকল সংকটে মুমিন বান্দার মুখ থেকে তাই উচ্চারিত হয়- ইন্না-লিল্লাহ! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাও কত বিস্তৃত দেখুন, তিনি বলেছেন,

إِذَا انْقَطَعَ شِسْعُ أَحَدِكُمْ فَلْيَسْتَرْجِعْ، فَإِنَّهُ مِنَ الْمَصَائِبِ.

যখন তোমাদের কারও জুতার ফিতা ছিঁড়ে যায় তখনো তোমরা ‘ইন্না-লিল্লাহ’ পড়ো। কেননা এটাও একটা বিপদ। -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৯২৪৪; মুসনাদে বাযযার, হাদীস ৩৪৭৫

যে কোনো রকম বিপদে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ইন্না-লিল্লাহ পড়া- পবিত্র কুরআনের ভাষায় এটি ধৈর্যশীলদের পরিচায়ক-

الَّذِیْنَ اِذَاۤ اَصَابَتْهُمْ مُّصِیْبَةٌ قَالُوْۤا اِنَّا لِلهِ وَ اِنَّاۤ اِلَیْهِ رٰجِعُوْنَ.

যারা যে কোনো রকম বিপদে আক্রান্ত হলে বলে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন- সন্দেহ নেই, আমরা আল্লাহরই, আর আমরা তো তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’ -সূরা বাকারা (২) : ১৫৬

আরবী ভাষার শব্দ ‘সবর’। এর শাব্দিক অর্থ হলো আটকে রাখা। বিপদে পড়লে আমরা যে সবরের কথা বলি, এর অর্থ হলো, শরীয়ত-নিষিদ্ধ সব রকম কাজে জড়ানো থেকে নিজেকে আটকে রাখা। বিপদের মুখেও এমন কোনো কাজ করা যাবে না, শরীয়ত আমাদের যার অনুমতি দেয়নি। যেমন, কারও মৃত্যুতে বিলাপ করা, দুঃখে-কষ্টে জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা, আল্লাহ পাকের শানে অসঙ্গত কথা বলা কিংবা মনে মনে অসঙ্গত কোনো বিশ্বাস পোষণ করা ইত্যাদি। এসবে না জড়িয়ে দয়াময় আল্লাহর ফয়সালাকে মেনে নিয়ে তাঁর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করা- এর নামই তো সবর। এই সবর মুমিনের হাতিয়ার। পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اسْتَعِیْنُوْا بِالصَّبْرِ وَ الصَّلٰوةِ اِنَّ اللهَ مَعَ الصّٰبِرِیْنَ.

হে মুমিনগণ! তোমরা সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও, নিশ্চয় আল্লাহ সবরকারীদের সঙ্গে রয়েছেন। -সূরা বাকারা (২) : ১৫৩

মুমিন বান্দা বিপদের মুখোমুখি হতে পারে দ্বীনের কথা প্রচার করতে গিয়ে, নিজের আদর্শ ও লক্ষ্যের ওপর টিকে থাকার সংগ্রামে। দ্বীনের পথে চলতে গিয়ে, দ্বীনের কথা বলতে গিয়ে কেউ যদি বিপদে পড়ে আর সবর করে, তখন আল্লাহ পাক তাকে পুরস্কৃত করবেন- এ তো স্বাভাবিক কথা। কিন্তু আমাদের জন্যে আশার কথা হলো, দ্বীনের সঙ্গে সামান্য সম্পর্কও নেই এমন ব্যক্তিগত কিংবা পার্থিব বিষয়েও যদি আমরা বিপদাক্রান্ত হয়ে সবরের পরিচয় দিই, তখনো আমাদের জন্যে রয়েছে দয়াময়ের পক্ষ থেকে পুরস্কারের ঘোষণা। হাত থেকে পড়ে কাচের দামি গ্লাসটা ভেঙে গেল, কিংবা বন্যার পানিতে মাঠভরা পাকা ধান তলিয়ে গেল, রাতের অন্ধকারে চোর হাতিয়ে নিয়ে গেল অর্থকড়ি- এমন বিপদে পড়েও যারা ‘ইন্না লিল্লাহ’ পড়ে, আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়, তাদের কথা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে-

اُولٰٓىِٕكَ عَلَیْهِمْ صَلَوٰتٌ مِّنْ رَّبِّهِمْ وَ رَحْمَةٌ وَ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُهْتَدُوْنَ.

তাদের ওপরই রয়েছে তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে শান্তি ও অনুগ্রহ, আর তারাই কেবল সঠিক পথপ্রাপ্ত। -সূরা বাকারা (২) : ১৫৭

দুনিয়াতে যত বিপদ, এর মধ্যে প্রিয়জন হারানোর বিপদটিই সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন। প্রিয়জন হতে পারে সন্তান, হতে পারে মা-বাবা কিংবা অন্য কেউ। এ কঠিন বিপদে যারা সওয়াবের আশায় সবর করবে তাদের পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে স্বয়ং রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে-

مَا لِعَبْدِي الْمُؤْمِنِ عِنْدِي جَزَاءٌ إِذَا قَبَضْتُ صَفِيَّهُ مِنْ أَهْلِ الدُّنْيَا ثُمَّ احْتَسَبَهُ إِلاَّ الْجَنَّةُ.

আমি যখন আমার মুমিন বান্দার কোনো আপনজনকে মৃত্যু দিই আর সে সবর করে, তখন আমার কাছে তার একমাত্র প্রতিদান হলো জান্নাত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪২৪

বিপদাপদ যে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে পরীক্ষাস্বরূপ, এ কথাটি হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে ভিন্নভাবে। সহীহ বুখারীর হাদীস, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

مَنْ يُرِدِ الله بِهِ خَيْرًا يُصِبْ مِنْهُ.

আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে বিপদে আক্রান্ত করেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৬৪৫

বিপদের সঙ্গে বান্দার ভালো-মন্দের সম্পর্ক আরেক হাদীসে আরও স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِعَبْدِهِ الخَيْرَ عَجَّلَ لَهُ العُقُوبَةَ فِي الدُّنْيَا، وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِعَبْدِهِ الشَّرَّ أَمْسَكَ عَنْهُ بِذَنْبِهِ حَتَّى يُوَافِيَ بِهِ يَوْمَ القِيَامَةِ.

আল্লাহ যখন তাঁর বান্দার কল্যাণ চান তখন দুনিয়াতে তার শাস্তি ত্বরান্বিত করেন, আর যখন কোনো বান্দার অকল্যাণ চান তখন তার পাপগুলো রেখে দিয়ে কিয়ামতের দিন তাঁর প্রাপ্য পূর্ণ করে দেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৯৬

আরেকটি হাদীস, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী-

إِنَّ عِظَمَ الجَزَاءِ مَعَ عِظَمِ البَلاَءِ، وَإِنَّ اللَّهَ إِذَا أَحَبَّ قَوْمًا ابْتَلاَهُمْ، فَمَنْ رَضِيَ فَلَهُ الرِّضَا، وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السَّخَطُ.

সত্যি, বড় পুরস্কার তো বড় বিপদের সঙ্গেই রয়েছে। আর আল্লাহ যখন কোনো সম্প্রদায়কে ভালোবাসেন তখন অবশ্যই তাদের পরীক্ষায় ফেলেন। তখন যে সন্তুষ্ট থাকে তার জন্যেই তাঁর সন্তুষ্টি, আর যে অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে তার প্রতি তাঁরও অসন্তুষ্টি। (প্রাগুক্ত)

এ দুই হাদীস সামনে রেখে আমরা বলতে পারি, মুমিন বান্দা নিজের কৃত অপরাধের কারণেও বিপদের মুখোমুখি হতে পারে, আবার বিপদাক্রান্ত হতে পারে প্রভুর সঙ্গে তার ভালোবাসার যাচাইস্বরূপও। যে কারণেই হোক, অনাকাক্সিক্ষত এ বিপদও তার জন্যে রহমত হয়ে থাকে। বিপদ যদি অপরাধের শাস্তিস্বরূপ হয়ে থাকে, তাহলে এ বিপদে ভুগে সে গোনাহমুক্ত হয়ে ওঠে। আর বিপদ যদি হয় প্রভুর প্রতি তার ভালোবাসার পরীক্ষা, তাহলে সবর করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে ভালোবাসার বন্ধন হবে আরও দৃঢ়।

বিপদ তাই যেমনই হোক, যে কারণেই হোক, আল্লাহ পাকের ফয়সালা মনে করে তা মেনে নেয়া, মনে কোনোরূপ মন্দ ধারণা পোষণ না করা আর সবরের সঙ্গে বিপদমুক্তির জন্যে আল্লাহ পাকের শরণাপন্ন হওয়া- এই তো মুমিন বান্দার কর্তব্য। বিপদে পড়ে সে অন্যকে দেখে অনুযোগের সুরে বলবে না- ‘বারবার আমিই কেন বিপদে পড়ি’ জাতীয় কোনো কথা। বরং চরম বিপদের মুহূর্তেও তার মুখ থেকে উচ্চারিত হবে- ‘الحمد لله على كل حال’ অর্থাৎ আল্লাহ পাক যখন যে অবস্থায় রাখেন সর্বাবস্থায় তাঁর জন্যেই সকল প্রশংসা। এ সবর যদি অর্জিত হয় তাহলে অভাবের কঠিন পরিস্থিতিতেও অন্যের ধনসম্পদের প্রতি না তাকিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সে বলবে- আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর শোকর। এর বিপরীত যারা, অট্টালিকার চূড়ায় বসেও উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারা কেবল আক্ষেপই করে যায়- আরেকটু যদি পেতাম, অমুকের মতো যদি এত সম্পদের মালিক হতাম ইত্যাদি।

সবরের এ ফযিলতের দিকে তাকিয়ে কেউ আবার বিপদ চেয়ে বসে কি না, হাদীস শরীফে সে বিষয়ে আবার সতর্কও করা হয়েছে। বিপদ তো এক অনাকাক্সিক্ষত বিষয়, সবরের সওয়াবের কারণে অনাকাক্সিক্ষত বিপদ কাক্সিক্ষত হতে পারে না। মানুষ মাত্রই বিপদ থেকে দূরে থাকতে চায়। বিপদে পড়ে গেলে মুক্তি কামনা করে। এটাই স্বাভাবিক। ইসলামের শিক্ষাও তাই। হাদীসের ভাষ্য-

أَيُّهَا النَّاسُ لاَ تَتَمَنَّوْا لِقَاءَ الْعَدُوِّ وَسَلُوا اللهَ الْعَافِيَةَ فَإِذَا لَقِيتُمُوهُمْ فَاصْبِرُوا.

(রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,) হে লোকসকল! তোমরা শত্রুর মুখে পড়ার কামনা করো না। বরং আল্লাহর কাছে আফিয়াত ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করো। তবে যখন তোমরা শত্রুর মুখোমুখি হয়ে পড়বে তখন সবর করো। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৯৬৫।।