শোকর ও কৃতজ্ঞতা : ফযীলত ও পদ্ধতি

শোকর ও কৃতজ্ঞতা : ফযীলত ও পদ্ধতি

শিব্বীর আহমদ

খোলাফায়ে রাশেদিনের বাইরে দু-চারজন সাহাবীর নামও যাদের জানা আছে, কিংবা মাঝেমধ্যে হলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় সাহাবীগণের নাম যারা পড়েন বা শোনেন, তাদের কারও কাছেই ‘হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা.’ নামটি অজানা থাকার কথা নয়। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন তাঁর এই প্রিয় সাহাবীটির হাত ধরে বললেন, ‘মুআয! আল্লাহর কসম, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ জানের শত্রু কুরাইশ কাফেররাও যার সততা আর বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি কখনো, প্রাণপ্রিয় সেই নবীর কোনো কথায় তাঁর কোনো সাহাবী সামান্য সন্দেহ পোষণ করবে- তা কি ভাবা যায়! সঙ্গীদের এ অকৃত্রিম আস্থা ও ভালোবাসার কথা তাঁরও অজানা নয়। অথচ তিনিই আল্লাহর নামে কসম করছেন, তাও আবার এক ঘনিষ্ঠ সাহাবীর সঙ্গে! সাহাবী মুআয রা.-ও তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, ‘আমার মা-বাবা আপনার জন্যে উৎসর্গিত হোক! আল্লাহর কসম, আমিও আপনাকে ভালোবাসি।’ এভাবে ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘মুআয! আমি তোমাকে বলছি, কখনোই নামাযের পরে এ দুআটি পড়তে ভুল করো না-

اللّهُمَّ أَعِنِّيْ عَلٰى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ  .

হে আল্লাহ! আপনার জিকির, আপনার কৃতজ্ঞতা ও শোকর আদায় এবং সুন্দর করে আপনার ইবাদত করতে আপনি আমাকে সাহায্য করুন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২১১৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫২৪

হাদীসের বাণী সূর্যালোকের ন্যায় পরিষ্কার, আল্লাহ তাআলার যিকির আর তাঁর সুন্দর ইবাদতের মতো তাঁর শোকর ও কৃতজ্ঞতা আদায়ও আমাদের ইসলামে এক পরম কাক্সিক্ষত বিষয়।

আল্লাহবিশ্বাসী প্রতিটি ঈমানদার ব্যক্তিই মনে করে, ভালো-মন্দ সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা সুখ-দুঃখ সবকিছুর তিনিই মালিক। তাঁর ইচ্ছাতেই পথের ফকির কখনো বড় অট্টালিকার মালিক হয়ে যায়, আর কাড়ি কাড়ি সম্পদের মালিকও সবকিছু হারিয়ে পথে নেমে আসে। মুমিনমাত্রই এ বিশ্বাস দৃঢ়তা ও আস্থার সঙ্গে হৃদয়ে লালন করে। এ বিশ্বাসে ভর করেই বিপদাক্রান্ত মুমিন ‘আল্লাহর ইচ্ছা’ বলে সান্ত্বনা পায়। আবার কোনো নিআমত পেলে এ বিশ্বাসেই সে উচ্চারণ করে- শোকর আলহামদু লিল্লাহ কিংবা এসবই আল্লাহর দান।

হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তাআলা বলেছিলেন, তোমার পরবর্তীতে আমি এক উম্মত পাঠাব, কাক্সিক্ষত কোনো বিষয় যদি তাদের হাসিল হয় তাহলে তারা আল্লাহর প্রশংসা করবে এবং শুকরিয়া আদায় করবে, আর যদি অনাকাক্সিক্ষত কোনো কিছু তাদের পেয়ে বসে তাহলে তারা সওয়াবের আশায় ধৈর্যধারণ করবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৭৫৪৫; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১২৮৯; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৪১৬৫; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ১৬৭০৪

উম্মতে মুহাম্মদীর এই চরিত্র এভাবেই আল্লাহ তাআলা প্রকাশ করেছেন হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের নিকট। আরেক হাদীসে বিষয়টি আরও পরিষ্কার প্রতিভাত হয়েছে। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ.

মুমিনের বিষয়াদি কত আশ্চর্যের! তার সবকিছুই কল্যাণকর। আর এটা তো কেবল মুমিনের ক্ষেত্রেই হতে পারে। সচ্ছলতায় সে শুকরিয়া আদায় করে, তখন তা তার জন্যে কল্যাণকর হয়। আর যদি তার ওপর কোনো বিপদ নেমে আসে তাহলে সে সবর করে, ফলে তাও তার জন্যে কল্যাণকর হয়ে যায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৯৯

কৃতজ্ঞতা আদায় যে কেবলই এক কাক্সিক্ষত বিষয় এমন নয়, বরং এর ব্যতিক্রম ঘটলে পবিত্র কুরআনে উচ্চারিত হয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারিও-

لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيْدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذابِيْ لَشَدِيْدٌ.

তোমরা যদি কৃতজ্ঞতা আদায় কর তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরও বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অস্বীকার কর তাহলে আমার আজাব অবশ্যই কঠিন। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৭

এ প্রসঙ্গে বুখারী শরীফে বর্ণিত একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বনি ইসরাঈলের তিন ব্যক্তি, তাদের একজন ছিল শ্বেতরোগী, একজনের মাথায় ছিল টাক, আরেকজন ছিল অন্ধ। আল্লাহ তাদের পরীক্ষা করতে চাইলেন। তাই তাদের নিকট এক ফেরেশতা পাঠালেন। ফেরেশতা প্রথমে শ্বেতরোগীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সবচেয়ে পছন্দনীয় জিনিস কোনটি? সে বলল, ‘(শরীরের) সুন্দর বর্ণ আর সুন্দর চামড়া। মানুষ যে আমাকে অপছন্দ করে!’ ফেরেশতা তখন তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গেই তার রোগ দূর হয়ে গেল এবং তার গায়ের রং ও চামড়া সুন্দর হয়ে গেল। এরপর ফেরেশতা তাকে বললেন, তোমার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদের কথা বলো! সে বলল, উট। তখনি তাকে একটি গর্ভবতী উটনী দেয়া হলো। ফেরেশতা তার জন্যে দুআ করলেন- আল্লাহ তাতে তোমার জন্যে বরকত দান করুন। এরপর ফেরেশতা চলে গেলেন টেকো ব্যক্তির কাছে। তাকেও জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সবচেয়ে পছন্দনীয় জিনিস কোনটি? সে বলল, ‘সুন্দর চুল। মানুষ যে আমাকে এ টাকের জন্যে অপছন্দ করে!’ ফেরেশতা তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গেই তার টাক দূর হয়ে গেল এবং তার মাথা সুন্দর সুন্দর চুলে ছেয়ে গেল। এরপর ফেরেশতা তাকে বললেন, তোমার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদের কথা বলো! সে বলল, গরু। তখনি তাকে একটি গর্ভবতী গাভী দেয়া হলো। ফেরেশতা তার জন্যে দুআ করলেন- আল্লাহ তাতে তোমার জন্যে বরকত দান করুন। সবশেষে ফেরেশতা গেলেন অন্ধব্যক্তির কাছে। তার কাছেও একই প্রশ্ন; তোমার সবচেয়ে পছন্দনীয় জিনিস কোনটি? সে বলল, ‘আল্লাহ যদি আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতেন, আমি তাহলে মানুষদের দেখতে পারতাম।’ ফেরেশতা তখন হাত বুলিয়ে দিলেন, আর সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখে দৃষ্টিশক্তি ফিরে এল। এরপর ফেরেশতা তাকে বললেন, তোমার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ কোনটি? সে বলল, ছাগল। তখনি তাকে একটি গর্ভবতী ছাগল দেয়া হলো। ফেরেশতা তার জন্যে দুআ করলেন- আল্লাহ তাতে তোমার জন্যে বরকত দান করুন। এরপর তাদের উট গরু আর ছাগলে আল্লাহ যথেষ্ট বরকত দিলেন। কারও মাঠভর্তি উট, কারও মাঠভর্তি গরু আর কারও মাঠভর্তি ছাগল। ফেরেশতা আবার এলেন। প্রথমেই উটের মালিকের কাছে গিয়ে বললেন, আমি মিসকিন, সফরে আমার সবকিছু হারিয়ে গেছে। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। তিনি তো তোমাকে সুন্দর গায়ের রং, সুন্দর চামড়া আর এ ধনসম্পদ দান করেছেন। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে একটি উট দাও, তাহলে আমি আমার সফর শেষ করে ফিরে যেতে পারব। সে বলল, আমার তো কত মানুষকে দিতে হয়! (তোমাকে দিতে পারছি না।) ফেরেশতা এরপর বলল, আমি তো মনে হচ্ছে তোমাকে চিনতে পারছি। তোমার কি শ্বেতরোগ ছিল না, যে কারণে মানুষ তোমাকে অপছন্দ করত? এরপর আল্লাহ তোমাকে এসব দান করলেন। সে বলল : এগুলো তো আমার বাপ-দাদার সম্পদ! ফেরেশতা বললেন, যদি তুমি মিথ্যা বলে থাক, তাহলে তুমি যেমন ছিলে আল্লাহ যেন তোমাকে সে অবস্থাতেই ফিরিয়ে দেন। এরপর ফেরেশতা গেলেন গরুর মালিকের কাছে। তার কাছেও একই ভাষায় সাহায্যের আবদার করলেন। সেও একই ভাষায় ফিরিয়ে দিল। ফেরেশতাও তার জন্যে একই বদদুআ করলেন; যদি তুমি মিথ্যা বলে থাক, তাহলে তুমি যেমন ছিলে আল্লাহ যেন তোমাকে সে অবস্থাতেই ফিরিয়ে দেন। এবার ফেরেশতা ছাগলের মালিকের কাছে গিয়ে বললেন, আমি মিসকিন মুসাফির, সফরে আমার সবকিছু হারিয়ে গেছে। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। তিনি তো তোমার চোখ ভালো করে দিয়েছেন আর এ ধনসম্পদ দান করেছেন। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে একটি ছাগল দাও, যেন আমি আমার সফর শেষ করে ফিরে যেতে পারি। সে বলল, আমি তো অন্ধ ছিলাম, আল্লাহ আমার চোখ ভালো করে দিয়েছেন; আমি দরিদ্র ছিলাম, তিনি আমাকে ধনসম্পদ দান করেছেন। তুমি যা ইচ্ছা নিয়ে নিতে পার। তুমি যাই কিছু নেবে আমি তোমাকে কিছু বলব না। ফেরেশতা বললেন, তোমার সম্পদ তোমার কাছেই থাক; তোমাদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছে, আল্লাহ তোমার ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তোমার দুই সঙ্গীর ওপর তিনি অসন্তুষ্ট। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৬৪

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষ আল্লাহ তাআলার কী পরিমাণ নিআমত ভোগ করে তা কি কল্পনা করা যায়! সুস্থ দেহ, সুস্থ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, সুস্থ মন, সুস্থ পরিবেশ- সবকিছুই তো তাঁর নিআমত। সামান্য অসুস্থতায় আক্রান্ত হলেই বুঝে আসে এ নিআমতের মর্ম। সুস্থ মাথা নিয়ে দিব্যি ছুটে বেড়াচ্ছে যে, মাথাব্যথার মতো দেখা যায় না এমন একটি রোগেও সে কাবু হয়ে পড়ে। উঠতে-বসতে, নিদ্রা-জাগরণে, ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আমরা তাঁর নিআমতের সাগরে ডুবে আছি সর্বক্ষণ। এ নিআমত গণনার সাধ্য নেই কারও। আল্লাহ পাক তো বলেই দিয়েছেন- وَإِنْ تَعُدُّوْا نِعْمَتَ اللهِ لا َتُحْصُوْهَا

তোমরা যদি আল্লাহর নিআমত গুনতে চাও তাহলে তা গুনে শেষ করতে পারবে না। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৩৪ প্রতিদিনকার প্রতিটি পদক্ষেপে তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শিখিয়ে গেছেন এ নিআমতের কৃতজ্ঞতাসম্বলিত বিভিন্ন দুআ। ভোরে ঘুম থেকে জাগার মধ্য দিয়ে যখন সূচনা হয় আমাদের দিনের, তখনকার দুআটি এমন-

اَلْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِيْ أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا، وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ.

অর্থাৎ সকল প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে মৃত্যু দেয়ার পর আবার জীবন দান করলেন আর তাঁর কাছেই তো আমাদের একত্রিত করা হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩১১২

খাবার খেলে আমরা পড়ি-

اَلْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِيْ أَطْعَمَنَا وَسَقَانَا، وَجَعَلَنَا مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ.

অর্থাৎ সকল প্রশংসা সেই আল্লাহ তাআলার, যিনি আমাদের পানাহার করিয়েছেন এবং আমাদেরকে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৫৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৫০

খাবার পেলেই যে কেউ খেতে পারে বিষয়টি এমন নয়। আমাদের চারপাশে এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়, যথেষ্ট সচ্ছলতা থাকার পরও ডাক্তারি বিধিনিষেধের কারণে যারা নিজেদের পছন্দের খাবারটিও খেতে পারেন না। তাই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত টাকাপয়সায় কেনা খাবার খাওয়ার পর এ দুআটি শিখিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন আমাদেরকে এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন- খাবার জোগাড় করতে পারা যেমন একটি নিআমত, তেমনি খেতে পারাও একটি নিআমত। আর উক্ত দুআর মধ্য দিয়ে এ নিআমতটিরই শুকরিয়া আদায় করা হয়। কৃতজ্ঞতা সম্বলিত এ দুআর তালিকাও ছোট নয়। যে কাজকর্মকে আমরা খুবই স্বাভাবিক মনে করি, স্বাভাবিকতায় সামান্য ব্যত্যয় ঘটলে আমরা বুঝি- আসলে এগুলোও আল্লাহর অনুগ্রহ। শুকরিয়া আদায়ের শিক্ষাও তাই জীবনের সর্বত্রই ছড়ানো। এমনকি যখন কেউ প্রস্রাব-পায়খানা সেরে বেরিয়ে আসে তখনো আমাদের শেখানো হয়েছে কৃতজ্ঞতার দুআ-

غُفْرَانَكَ. اَلْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِيْ أَذْهَبَ عَنِّيْ الْأَذٰى وَعَافَانِيْ.

অর্থাৎ তোমার কাছেই ক্ষমা চাই হে প্রভু! সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি আমার কষ্টকর বস্তুগুলো সরিয়ে দিয়েছেন এবং আমাকে নিরাপদ রেখেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩০১; আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ, ইবনুস সুন্নী, হাদীস ২২

প্রতিদিনকার এসব সাধারণ নিআমতের পাশাপাশি আল্লাহ তাআলা অনেক বিশেষ নিআমতও দিয়ে থাকেন। আল্লাহর নিআমতের কথা আলোচনায় এলে আমাদের সামনে প্রথমে এ বিশেষ নিআমতগুলোই হাযির হয়। যেমন, কাউকে তিনি দিয়ে থাকেন তুখোড় মেধাশক্তি, কাউকে গভীর জ্ঞান, কাউকে রাশি রাশি ধনসম্পদ, কাউকে সুসন্তান, কাউকে সুনাম-সুখ্যাতি, আরও কত কী! মুমিন বান্দা জীবনে যা কিছু পায়, সবকিছুকেই সে আল্লাহর নিআমত বলেই বিশ্বাস করে। এসবকে নিজের মেধা-প্রতিভার ফসল মনে করবে সে কীভাবে, যেখানে মেধা-প্রতিভাকেই সে আল্লাহর দেয়া নিআমত বলে মেনে নেয়! নিজের যে কোনো অর্জনে তাই সে মহান প্রভুর দরবারেই সেজদাবনত হয়, কৃতজ্ঞচিত্তে গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে সে উচ্চারণ করে- আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহবিশ্বাসী মুমিন বান্দার এ এক অনন্য গুণ।

কোনো নিআমতের শুকরিয়া আদায়ের জন্যে অপরিহার্য হলো, সে নিআমতটিকে কাজে লাগানোর সময় নিআমতদাতার ইচ্ছা ও চাওয়াকে গুরুত্ব দেয়া, তাঁর আনুগত্যে তা ব্যবহার করা। ব্যবসায় লাভ হলে আলহামদু লিল্লাহ বলার পর যদি সে লাভের অর্থ আল্লাহ তাআলার নাফরমানিতে খরচ করা হয় তাহলে এটা কেমন কৃতজ্ঞতা হলো!

আল্লাহর নিআমত পেলে বান্দা আনন্দিত হয়। আর সেই আনন্দ আল্লাহর অন্য বান্দাদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়াটাও এক প্রকার কৃতজ্ঞতা। আল্লাহ নিজেই বলেছেন : وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ

আর তুমি তোমার প্রভুর নিআমতের কথা বলো। -সূরা দুহা (৯৩) : ১১

নিআমতের কথা অন্যকে জানানোই আনন্দ ভাগ করে নেয়ার একমাত্র পদ্ধতি নয়। বিয়ের পর ওলিমা অনুষ্ঠান, সন্তান জন্মের পর আকিকা- এসব তো আল্লাহর নিআমত স্মরণ করেই আয়োজিত হয়। তবে কথা হলো, এসব আনন্দ-আয়োজনের মধ্যে অবশ্যই কৃতজ্ঞতার মানসিকতা পোষণ করতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে- আনন্দের এ উপলক্ষ অর্জন ব্যক্তিগত কোনো কৃতিত্ব নয়, বরং মহান প্রভু আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ অনুগ্রহ ও দান। পরীক্ষায় পাশ, নতুন চাকরি লাভ ইত্যাদি বিভিন্ন উপলক্ষে আমরা মিষ্টিমুখ বা এজাতীয় যে আয়োজন করি, উক্ত বিশ্বাস মনে ধারণ করতে পারলে এ আয়োজনেও কৃতজ্ঞতা আদায় হতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো সফর থেকে মদীনায় ফিরে আসতেন তখন তিনি একটি উট কিংবা গরু জবাই করে সাথী-সঙ্গী ও উপস্থিত সবার আপ্যায়নের আয়োজন করতেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৩০৮৯) ইমাম বুখারী রাহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর আমলও বর্ণনা করেছেন এভাবে- যখন তিনি সফর থেকে ফিরে আসতেন তখন তার সঙ্গে যারা দেখা করতে আসত তাদের কারণে তিনি রোযা রাখতেন না। বাড়িতে থাকাবস্থায় তিনি বেশি বেশি নফল রোযা রাখতেন। কিন্তু সফরে থাকাকালীন নফল-ফরয কোনো রোযাই রাখতেন না। সফর থেকে ফিরে এসে আবার রোযা শুরু। যেদিন তিনি সফর থেকে ফিরে আসতেন, স্বাভাবিকভাবেই সেদিন তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে অনেক আপনজন ভিড় করত। তাদের সম্মানে তিনি সেদিন রোযা রাখতেন না। (ফাতহুল বারী, বাবুত তআমি ইনদাল কুদুম)

আল্লাহ তাআলার নিআমতের কৃতজ্ঞতা আদায়ে নফল রোযা-নামাযের কথাও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি সোমবারে রোযা রাখতেন। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,

ذَاكَ يَوْمٌ وُلِدْتُ فِيهِ وَيَوْمٌ بُعِثْتُ أَوْ أُنْزِلَ عَلَيَّ فِيهِ .

এটা এমন দিন, যাতে আমার জন্ম হয়েছিল আর এ দিনেই আমার কাছে ওহী আসার সূচনা হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২

আর রাত জেগে জেগে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে নফল নামায পড়তে গিয়ে কখনো তাঁর পা ফুলে যেত। হযরত আয়েশা রা. একদিন তাই জানতে চাইলেন- আপনি এত কষ্ট করেন কেন, আল্লাহ কি আপনার আগে-পরের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেননি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন,

أَفَلاَ أُحِبُّ أَنْ أَكُونَ عَبْدًا شَكُورًا

আমি কি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হতে চাই না? -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৩৭

এ কৃতজ্ঞতা মুমিনের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। পরকালীন সমৃদ্ধির পাশাপাশি দুনিয়ার জীবনেও আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আরও অধিক পরিমাণ নিআমত লাভের মাধ্যম এ কৃতজ্ঞতা। আর আখেরাতের অসীম পুরস্কারের ঘোষণা তো আছেই। উদাহরণস্বরূপ একটি হাদীস উদ্ধৃত করেই শেষ করছি- হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

الطَّاعِمُ الشَّاكِرُ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ الصَّائِمِ الصَّابِرِ খেয়ে যে আল্লাহর শোকর আদায় করে সে ধৈর্যশীল রোযাদার ব্যক্তির সমান পুরস্কার লাভ করবে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৬৫।।