শাবানের পনেরতম রজনী উদযাপন, শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি

শাবানের পনেরতম রজনী উদযাপন, শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি
লেখক : আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায রহ.
অনুবাদ : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ

حكم الاحتفال بليلة النصف من شعبان للشيخ عبد العزيز بن عبد الله بن باز رحمه الله

‘মধ্য শাবানের রাত উদযাপনের বিধান’ এর সার-সংক্ষেপ তুলে ধরব। তার এ প্রবন্ধে অনেক উলামায়ে কিরামের মতামত তুলে ধরা হয়েছে।

তিনি বলেছেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ

اليوم أكملت لكم دينكم وأتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم الإسلام دينا. (المائدة : ৩)

অর্থঃ আজ আমি তোমাদের দীনকে তোমাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের জন্য আমার নেআমাত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন হিসাবে মনোনীত করলাম। (সূরা আল – মায়িদা: ৩)

 

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেনঃ শাবানের পনেরতম রজনী

أم لهم شركاء شرعوا لهم من الدين ما لم ياذن به الله.(الشورى : ২১)

অর্থঃ তাদের কি এমন কতগুলো শরীক আছে যারা তাদের জন্য ধর্মের এমন বিধান দিয়েছে যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? (সূরা আশ শুরা: ২১)

হাদীসে এসেছেঃ

عن عائشة رضى الله عنها عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال : من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد.

(رواه البخاري ومسلم)

অর্থঃ যে আমাদের এ ধর্মে এমন কিছুর প্রচলন করবে যা ধর্মের মধ্যে ছিল না তা প্রত্যাখ্যাত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

হাদীসে আরও এসেছেঃ

عن جابر رضى الله عنه أن النبى صلى الله عليه وسلم كان يقول في خطبة يوم الجمعة : أما بعد فإن خير الحديث

كتاب الله وخير الهدى هدى محمد صلى الله عليه وسلم وشر الأمور محدثاتها وكل بدعة ضلالة.

(رواه مسلم

অর্থঃ সাহাবী জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমু‘আর খুতবায় বলতেনঃ আর শুনে রেখ! সর্বোত্তম কথা হল আল্লাহর কিতাব ও সর্বোত্তম পথ-নির্দেশ হল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পথ-নির্দেশ। আর ধর্মে নতুন বিষয় প্রচলন করা হল সর্ব নিকৃষ্ট বিষয়। এবং সব ধরনের বিদআতই পথভ্রষ্টতা। (সহীহ মুসলিম)

এ বিষয়ে অনেক আয়াতে কারীমা ও হাদীস রয়েছে যা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। আর নবী কারীম (ﷺ) তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে কোন রকম অলসতা করেননি বা কার্পণ্যতা দেখাননি। ইসলাম ধর্মের সকল খুটিনাটি বিষয় তিনি স্পষ্টভাবে তাঁর উম্মতের সামনে বর্ণনা করে গেছেন যা আজ পর্যন্ত সুরক্ষিত রয়েছে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর যে সমস্ত নতুন আচার-অনুষ্ঠান, কাজ ও বিশ্বাস ধর্মের আচার বলে যা চালিয়ে দেয়া হবে তা সবগুলো প্রত্যাখ্যাত বিদআত বলেই পরিগণিত হবে, উহার প্রচলনকারী যে কেউ হোক না কেন এবং উদ্দেশ্য যত মহ হোক না কেন। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) ও তাদের পরবর্তী উলামায়ে ইসলাম এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন বলে তারা বিদআতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ও অন্যদের বিদ‘আতের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।

এ ধারাবাহিকতায় উলামায়ে কিরাম মধ্য শাবানের রাত উদযাপন ও ঐদিন সিয়াম পালন করাকে বিদআত বলেছেন। কারণ এ বিষয়ের উপর ভিত্তি করে আ‘মাল করা যেতে পারে এমন কোন দলীল নেই। যা আছে তা হল কিছু দুর্বল হাদীস যার উপর ভিত্তি করে আ‘মাল করা যায় না। উক্ত রাতে স্বলাত আদায়ের ফযীলাতের যে সকল হাদীস পাওয়া যায় তা বানোয়াট। এ ব্যাপারে হাফেয ইবনে রজব রহ. তার কিতাব লাতায়িফুল মায়ারিফে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

একটি কথা অবশ্যই বলতে হয় যে, দুর্বল হাদীস ঐ সকল আ‘মাল ও ইবাদাতের ক্ষেত্রে গ্রহণ করা যায় যে সকল আ‘মাল কোন সহীহ হাদীস দ্বারা ইতোপূর্বে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু মধ্য শাবানের রাতে একত্র হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করার ক্ষেত্রে কোন সহীহ হাদীস নেই। এ মূল নীতিটি ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. উল্লেখ করেছেন।

সকল উলামায়ে.কেরামের একটি ব্যাপারে ইজমা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, যে সকল ব্যাপারে বিতর্ক বা ইখতিলাফ রয়েছে সে সকল বিষয় কুরআন ও সুন্নাহর কাছে ন্যস্ত করা হবে। কুরআন অথবা হাদীস যে সিদ্ধান্ত দেবে সেই মোতাবেক আ‘মাল করা ওয়াজিব।

এ কথা তো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই বলেছেনঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا (النساء : ৫৯)

অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তাহলে আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাদের, যারা তোমাদের মধ্যে (ধর্মীয় জ্ঞানে ও শাসনের ক্ষেত্রে) ক্ষমতার অধিকারী; কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ হলে তা ন্যস্ত কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর। এটাই উত্তম ও পরিণামে উ কৃষ্টতর। (সূরা আন নি(ﷺ) ৫৯)

এ বিষয়ে অসংখ্য আয়াত ও হাদীস রয়েছে।

হাফেয ইবনে রজব রহ. তার কিতাব লাতায়িফুল মায়ারিফে লিখেছেনঃ

“তাবেয়ীদের যুগে সিরিয়ায় খালিদ ইবনে মা’দান, মকহুল, লুকমান ইবনে আমের প্রমুখ আলেম এ রাতকে মর্যাদা দিতে শুরু করেন এবং এ রাতে বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। তখন লোকেরা তাদের থেকে এটা অনুসরণ করতে আরম্ভ করল। এরপর লোকদের মধ্যে মতানৈক্য শুরু হল; বসরা অঞ্চলের অনেক আবেদগণ এ রাতকে গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু মক্কা ও মদীনার আলিমগণ এটাকে বিদআত বলে প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর সিরিয়াবাসী আলেমগণ দুই ভাগ হয়ে গেলেন। একদল এ রাতে মাসজিদে একত্র হয়ে ইবাদত-বন্দেগী করতেন। এদের মধ্যে ছিলেন খালেদ ইবনে মা’দান, লোকমান ইবনে আমের। ইসহাক ইবনে রাহভিয়াহও তাদের অনুরূপ মত পোষণ করতেন।

আলেমদের অন্যদল বলতেনঃ এ রাতে মসজিদে একত্র হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করা মাকরূহ, তবে কেহ ব্যক্তিগতভাবে ইবাদত-বন্দেগী করলে তাতে দোষের কিছু নেই। ইমাম আওযায়ী এ মত পোষণ করতেন।

মোট কথা হল, মধ্য শাবানের রাতের আ‘মাল সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবায়ে কেরামদের থেকে কোন কিছু প্রমাণিত নয়। যা কিছু পাওয়া যায় তা তাবেয়ীগণের যুগে সিরিয়ার একদল আলেমের ‘আমল।”

বিশুদ্ধ কথা হল, এ রাতে ব্যক্তিগত আ‘মাল সম্পর্কে ইমাম আওযায়ী ও ইবনে রজব রহ. এর মতামত যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে তা তাদের ব্যক্তিগত অভিমত যা সহীহ নয়। আর এটাতো সকল আলেমে দীনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত যে, শরয়ীভাবে প্রমাণিত নয় তা ব্যক্তিগত হোক বা সমষ্টিগত, প্রকাশ্যে হোক অথবা গোপনে হোক তা কোন মুসলিমের ধর্মীয় আ‘মাল হিসাবে পালন করা জায়েয নয়। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) থেকে বর্ণিত নিম্নের হাদীস হল আম তথা ব্যাপক অর্থবোধক। তিনি বলেছেনঃ من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد. (رواه مسلم)

অর্থঃ যে কেহ এমন আ‘মাল করবে যা করতে আমরা (ধর্মীয়ভাবে) নির্দেশ দেইনি তা প্রত্যাখ্যাত। (মুসলিম)

ইমাম আবূ বকর আত-তারতূশী রহ. তার কিতাব (الحوادث والبدع) ‘আল-হাওয়াদিছ ওয়াল বিদ‘আতে উল্লেখ করেনঃ ইবনে ওয়াদ্দাহ যায়েদ বিন আসলাম সূত্রে বর্ণনা করে বলেনঃ আমাদের কোন উস্তাদ বা কোন ফকীহকে মধ্য শাবানের রাতকে কোন রকম গুরুত্ব দিতে দেখিনি। তারা মাকহূলের হাদীসের দিকেও তাকাননি এবং এ রাতকে অন্য রাতের চেয়ে আমলের ক্ষেত্রে মর্যাদা সম্পন্ন মনে করতেন না।

হাফেয ইরাকী রহ. বলেনঃ মধ্য শাবানের রাতে স্বলাত আদায় সম্পর্কিত হাদীসগুলো বানোয়াট বা জাল এবং এটা আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি মিথ্যা আরোপের শামিল।

এ সম্পর্কে সকল উলামাদের মতামত যদি উল্লেখ করতে যাই তাহলে বিরাট এক গ্রন্থ হয়ে যাবে। তবে সত্যানুরাগীদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যা ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

মধ্য শাবানের রাতে স্বলাত আদায়ের জন্য একত্র হওয়া, ঐ দিন সিয়াম পালন করা ইত্যাদি নিকৃষ্ট বিদআত। অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম এটাই বলেছেন। এ ধরনের আ‘মাল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যেমন ছিল না তেমনি ছিল না তাঁর সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) এর সময়ে। যদি এ রাতে ইবাদত- বন্দেগী করা সওয়াবের কাজ হত তাহলে রাসূলে কারীম (ﷺ) উম্মতকে সে সম্পর্কে সতর্ক ও উৎসাহিত করতে কার্পণ্য করতেন না। যেমন তিনি কার্পণ্য করেননি লাইলাতুল কদর ও রমজানের শেষ দশ দিন ইবাদত-বন্দেগী করার ব্যাপারে মুসলিমদের উৎসাহিত করতে।

যদি মধ্য শাবানের রাতে অথবা রজব মাসের প্রথম জুমু‘আর রাতে বা মি’রাজের রাতে ইবাদত-বন্দেগী করা সওয়াবের কাজ হত তাহলে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) উম্মতকে এ ব্যাপারে অবশ্যই দিক-নির্দেশনা দিতেন। আর তিনি যদি দিক-নির্দেশনা দিতেন তাহলে তার সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) কোনভাবেই তা গোপন করতেন না। তারা তা অবশ্যই জোরে শোরে প্রচার করতেন। তারা তো নবীগণের পর উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।”

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! চলমান শিরোনামে এতক্ষণ যা বলা হল তা ছিল শায়খ আবদুল আযীয আবদুল্লাহ বিন বাযের বক্তব্যের সার কথা।

কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, শবে বরাতের বিপক্ষে উলামাদের বক্তব্য উল্লেখ করলেন, কিন্তু শবে বরাত উদযাপনের পক্ষেও তো অনেক বিখ্যাত উলামাদের বক্তব্য আছে তা তো উল্লেখ করলেন না। তাই ব্যাপারটা কি একপেশে ও ইনসাফ বহির্ভূত হয়ে গেল না?

এর জবাবে আমি বলবঃ দেখুন, কোন বিষয় বিদআত হওয়ার ক্ষেত্রে উলামাদের বক্তব্য যথেষ্ট। কেননা কুরআন ও হাদীসে কোন বিষয়কে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি যে, অমুক কাজটি বিদআত। তাই আলেমগণ যেটাকে বিদআত বলে রায় দিবেন সেটা বিদআতই হবে। বিদআত নির্ধারণের দায়িত্ব আলেমদের। কিন্তু কোন বিষয়কে ওয়াজিব, সুন্নাত বা মুস্তাহাব অথবা সওয়াবের কাজ বলে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আলেমদের বক্তব্য যথেষ্ট হবে না যদি না উহার পক্ষে কুরআন ও হাদীসের সহীহ দলীল থাকে। অতএব কোন বিষয় বিদআত হওয়ার ক্ষেত্রে উলামাদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য, কিন্তু সুন্নাত হওয়ার ব্যাপারে নয়।

আর এ কারণে আমরা শবে বরাত প্রচলনের সমর্থনে আলেমদের বক্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি না।

এ বিবেচনায় যে সকল আলেম শবে বরাত উদযাপন করাকে বিদআত বলেছেন তাদের বক্তব্য গ্রহণ করতে হবে। যারা শবে বরাতের পক্ষে বলেছেন তাদের বক্তব্য এ জন্য গ্রহণ করা যাবে না যে, তা কুরআন ও সুন্নাহর সহীহ দলীলে উত্তীর্ণ নয়।

সমাপ্ত