যে ব্যক্তি যমানাকে দোষারোপ করে সে মূলতঃ আল্লাহকেই দোষারোপ করে ও গালি দেয়

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَقَالُوا مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ وَمَا لَهُمْ بِذَلِكَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ
“অবিশ্বাসীরা বলে, ‘শুধু দুনিয়ার জীবনই আমাদের জীবন। আমরা এখানেই মরি ও বাঁচি। যমানা ব্যতীত অন্য কিছুই আমাদেরকে ধ্বংস করতে পারেনা। তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই। তারা কেবল অনুমান করে কথা বলে”। (সূরা জাসিয়াঃ ২৪)

 

ব্যাখ্যাঃ হাফেয ইমাদুদ্দীন ইবনে কাছীর (রঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেনঃ আল্লাহ তাআলা এখানে কাফেরদের দাহরীয়াহ সম্প্রদায় এবং পরকালকে অস্বীকারকারী আরব মুশরিকদের কথা বলেছেন। আরবেশর কাফের-মুশরিকদের মধ্যে যারা দাহরীয়া মতবাদের অনুসারী ছিল, তারা বলতঃ দুনিয়ার জীবনের পর আর কোন জীবন নেই। আমরা এখানেই জীবিত থাকি এবং এখানেই মৃত্যু বরণ করি। অর্থাৎ এই দুনিয়া ব্যতীত আর কোন ঘর নেই। এখানে একদল মৃত্যু বরণ করে। আরেক দল আসে এবং তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়। না আছে কোন পুনরুত্থান, না আছে কিয়ামত। পরকালকে অস্বীকারকারী আরব মুশরিকদের এটিই ছিল কথা। আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী দার্শনিকদের কথাও তাই। তারা সৃষ্টিজীবের নতুন করে পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে। আল্লাহ তাদের কথা নকল করে বলেছেন যে, তারা বলে মহা কালই আমাদেরকে ধ্বংস করে। আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই। তারা কেবল অনুমান করে কথা বলে”। অর্থাৎ তারা শুধু ধারণা ও কল্পনা করে থাকে।
সহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সাল্ল¬াল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেছেনঃ আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
(يُؤْذِينِي ابْنُ آدَمَ يَسُبُّ الدَّهْرَ وَأَنَا الدَّهْرُ بِيَدِي الأَمْرُ أُقَلِّبُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ)
“বনী আদম আমাকে কষ্ট দেয়। তারা মহাকালকে গালি দেয়। অথচ আমিই মহাকাল। আমার হাতেই সকল ক্ষমতা। রাত-দিনকে আমিই পরিবর্তন করি”। অন্য বর্ণনা আছে, “তোমরা যমানাকে গালি দিয়োনা। কারণ, আল্ল¬াহই হচ্ছেন যমানা।
…………………………………………………..
ব্যাখ্যাঃ শরহুস সুন্নাহয় ইমাম বগবী (রঃ) বলেনঃ হাদীছটি সহীহ হওয়ার ব্যাপারে ইমাম বুখারী ও মুসলিম একমত পোষণ করেছেন। তারা মা’মারের সূত্রে একাধিক সনদে আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
হাফেয ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ যুগকে দোষারোপ করা এবং বিপদাপদের সময় যামানাকে গালি দেয়া আরবদের অন্যতম অভ্যাস ছিল। কেননা যে সমস্ত মুসীবত ও কষ্ট তাদেরকে আক্রমণ করত, সেগুলোকে তারা যামানার দিকেই নিসবত (সম্পৃক্ত) করত। তারা বলত যে, তাদের কালের মসীবত ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং যুগ তাদেরকে বরবাদ করে দিয়েছে। সুতরাং মসীবতের কবলে পতিত হয়ে যখন তারা মসীবতগুলোকে যামানার দিকে নিসবত করত, তখন তারা মূলতঃ যামানার স্রষ্টাকেই গালি দিত। কেননা প্রকৃত অর্থে সকল বস্তুর স্রষ্টা ও কর্তা একমাত্র আল্লাহ। এ জন্যই যামানাকে গালি দিতে লোকদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। ইমাম ইবনে কাছীরের বক্তব্য সংক্ষিপ্তভাবে এখানেই শেষ।
আব্বাসী যুগের কবিদের কবিতায় যামানাকে গালি দেয়া এবং কাজকর্ম ও ঘটনাপ্রবাহকে মহাকালের দিকে নিসবত করার প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন ইবনুল মু’তায্য এবং মুতানাব্বী এবং অন্যান্য কবিগণের কথা বলা যেতে পারে। তবে কোন বছরকে অভাব ও দুর্ভিক্ষের বছর বলা যামানাকে গালি দেয়ার অন্তর্ভূক্ত নয়। আল্লাহ তাআলা সূরা ইউসুফের ৪৮ নং আয়াতে বলেনঃ
ثُمَّ يَأْتِي مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ سَبْعٌ شِدَادٌ يَأْكُلْنَ مَا قَدَّمْتُمْ لَهُنَّ إِلَّا قَلِيلًا مِمَّا تُحْصِنُونَ
“অতঃপর আসবে দুর্ভিক্ষের সাত বছর; এ সময়ের জন্য তোমরা যে শস্য জমা করবে তার সমস্তই এসময়ে খেয়ে যাবে। কিন্তু অল্প পরিমাণ ব্যতীত, যা তোমরা সংরক্ষণ করে রাখবে”।
কোন কোন কবি বলেছেনঃ
إن الليالي من الزمان مَهُولة تُطوى وتُنشر بينها الأعمار
যামানার রাত্রিসমূহ খুবই ভয়ংকর। এর মধ্যে মানুষের বয়স কমানো ও বাড়ানো হয়।
فقِصارهنّ مع الهموم طويلة وطِوالهن مع السرور قِصار
দুঃশ্চিন্তা ও বেদনাপূর্ণ রাতগুলো খুব ছোট হলেও তা অনেক দীর্ঘ অনুভব হয়। আর আনন্দময় রাত খুব দীর্ঘ হলেও তা হয় খুবই সংক্ষিপ্ত।
আব্বাসী যুগের কবি আবু তাম্মাম বলেনঃ
أعوام وصْل كاد ينسي طيبها ذِكرُ النّوى فكأنها أيام
বিপদাপদের স্মরণ সুখের বছরগুলো প্রায় ভুলিয়েই দিয়েছে। মনে হয় সেগুলো ছিল মাত্র কয়েক দিন
ثم انبرت أيام هجر أعقبت نحوي أسىً فكأنها أعوام
অতঃপর বিরহের দিনগুলো সম্মুখে এসেছে। তার পথ ধরেই আসল কষ্টের কিছু দিনগুলো। মনে হচ্ছিল সে দিনগুলো অনেক বছর
ثم انقضت تلك السنون وأهلها فكأنها وكأنهم أحلام
অতঃপর চলে গেছে সেই কঠিন বছরগুলো এবং তাতে যারা ছিল। সেই বছরগুলো এবং সে সময়ের লোকেরা কেবল রয়ে গেছে স্মৃতির পাতায়।

নোটঃ উক্ত কথাগুলো তাওহীদে কামাল তথা পরিপূর্ণ তাওহীদের পরিপন্থী। কারণ এখানে সুখ-শান্তি ও বিপদাপদকে তার প্রকৃত সষ্টার দিকে নিসবত না করে কালের দিকে নিসবত করা হয়েছে এবং কালের আবর্তন-বিবর্তনকেই দুঃখ-বেদনার কারণ হিসাবে উল্লখ করে কালকেই দোষারোপ করা হয়েছে। কাল যেহেতু আল্লাহর সৃষ্টি ও আজ্ঞাবহ সে কারণে কালকে দোষারোপ করার মাধ্যমে আল্লাহকেই দোষারোপ করা হয়। তাই মুমনিদের উচিত যামানাকে দোষারোপ না করা এবং তাকে গালি না দেয়া।
এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত মাসআলাগুলো জানা যায়ঃ
১) কাল বা যমানাকে গালি দেয়া নিষেধ।
২) যমানাকে গালি দেয়া আল্লাহকে কষ্ট দেয়ারই নামান্তর।
৩) فإن الله هو الدهر ‘আল্লাহই হচ্ছেন যমানা’ রাসূল সাল্লাল্ল¬াহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর বাণীর মধ্যে গভীর চিন্তার বিষয় নিহিত আছে।
৪) বান্দার অন্তরে আল্লাহকে গালি দেয়ার ইচ্ছা না থাকলেও অসাবধনতা বশতঃ মনের অগোচরে তাঁকে গালি দিয়ে ফেলতে পারে।

 

লেখকঃ আব্দুল্লাহ শাহেদ আলমাদানী।।