মিথ্যা বলা হারাম

মিথ্যা বলা হারাম
==================================================================

মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ وَلَا تَقۡفُ مَا لَيۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٌۚ ٣٦ ﴾ [الاسراء: ٣٦]
অর্থাৎ যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই সেই বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হইয়ো না। (সূরা ইসরা ৩৬ আয়াত)

তিনি আরও বলেছেন,
﴿ مَّا يَلۡفِظُ مِن قَوۡلٍ إِلَّا لَدَيۡهِ رَقِيبٌ عَتِيدٞ ١٨ ﴾ [ق: ١٨]
অর্থাৎ মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করুক না কেন তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে। [ক্বাফ ১৮ আয়াত)

হাদীসসমূহ:

1/1550 وَعَنِ ابنِ مَسعُودٍ رضي الله عنه قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: «إنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى البِرِّ، وَإِنَّ البِرَّ يَهْدِي إِلَى الجَنَّةِ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَصْدُقُ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ صِدِّيقاً . وَإِنَّ الكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الفُجُورِ، وَإِنَّ الفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ، وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَكْذِبُ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذَّاباً». متفقٌ عَلَيْهِ
১/১৫৫০। ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘নিশ্চয় সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায়। আর পুণ্য জান্নাতের দিকে পথ নির্দেশনা করে। আর মানুষ সত্য কথা বলতে থাকে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নিকট তাকে ‘মহা-সত্যবাদী’ রূপে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর নিঃসন্দেহে মিথ্যাবাদিতা নির্লজ্জতা ও পাপাচারের দিকে নিয়ে যায়। আর পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। আর মানুষ মিথ্যা বলতে থাকে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নিকট তাকে ‘মহা-মিথ্যাবাদী’ রূপে লিপিবদ্ধ করা হয়। (বুখারী ও মুসলিম) [1]

2/1551 وَعَنْ عَبدِ اللهِ بنِ عَمرِو بنِ العَاصِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا: أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ: «أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ، كَانَ مُنَافِقاً خَالِصاً، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ، كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْ نِفاقٍ حَتَّى يَدَعَهَا : إِذَا اؤْتُمِنَ خانَ، وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ» . متفق عَلَيْهِ
২/১৫৫১। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবন ‘আস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে, সে খাঁটি মুনাফিক গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তির মাঝে তার মধ্য হতে একটি স্বভাব থাকবে, তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকদের একটি স্বভাব থেকে যাবে। [সে স্বভাবগুলি হল,]

১। তার কাছে আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে।
২। সে কথা বললে মিথ্যা বলে।
৩। ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে এবং
৪। ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীল ভাষা বলে।’’ (বুখারী ও মুসলিম)[2]

এ মর্মে আবূ হুরাইরার হাদিস ‘অঙ্গীকার পালন’ পরিচ্ছেদে ১/৬৯৪ নম্বরে [এবং উক্ত হাদিস ২/৬৯৫ নম্বরে] গত হয়েছে।

3/1552 وَعَنِ ابنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا، عَنِ النِّبي صلى الله عليه وسلم قَالَ: «مَنْ تَحَلَّمَ بِحُلْمٍ لَمْ يَرَهُ، كُلِّفَ أَنْ يَعْقِدَ بَيْنَ شَعِيرَتَيْن وَلَنْ يَفْعَلَ، وَمَنِ اسْتَمَعَ إِلَى حَدِيثِ قَوْمٍ وَهُمْ لَهُ كَارِهُونَ، صُبَّ فِي أُذُنَيْهِ الآنُكُ يَوْمَ القِيَامَةِ، وَمَنْ صَوَّرَ صُورَةً عُذِّبَ وَكُلِّفَ أَنْ يَنْفُخَ فِيهَا الرُّوحَ وَلَيْسَ بنافِخٍ». رواه البخاري
৩/১৫৫২। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি এমন স্বপ্ন ব্যক্ত করল, যা সে দেখেনি। [কিয়ামতের দিনে] তাকে দু’টি যব দানার মাঝে সংযোগ সাধন করতে আদেশ করা হবে; কিন্তু সে তা কস্মিনকালেও পারবে না। যে ব্যক্তি কোন জনগোষ্ঠীর কথা শুনবার জন্য কান পাতে, যা তারা আদৌ পছন্দ করে না, কিয়ামতের দিনে তার কানে গলিত সীসা ঢেলে দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি কোন [প্রাণীর] ছবি তৈরি করে, কিয়ামতের দিন তাকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য আদেশ করা হবে, অথচ সে তা করতে পারবে না।’’ (বুখারী) [3]

4/1553 وَعَنِ ابنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم: «أَفْرَى الفِرَى أَنْ يُرِيَ الرَّجُلُ عَيْنَيْهِ مَا لَمْ تَرَيَا» . رواه البخاري
৪/১৫৫৩। ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট মিথ্যা হল, মানুষ আপন চক্ষুকে এমন কিছু দেখায়, যা সে দেখেনি।’’ [অর্থাৎ সে যা দেখেনি সে সম্পর্কে মিথ্যা করে বলে, ‘আমি দেখেছি।’] (বুখারী) [4]

5/1554 وَعَنْ سَمُرَةَ بنِ جُنْدُبٍ رضي الله عنه قَالَ: كَانَ رَسُول اللهِ صلى الله عليه وسلم مِمَّا يُكْثِرُ أَنْ يَقُوْلَ لأَصْحَابِهِ : «هَلْ رَأَى أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنْ رُؤْيَا ؟» فَيَقُصُّ عَلَيْهِ مَنْ شَاءَ اللهُ أَنْ يَقُصَّ، وَإِنَّهُ قَالَ لَنَا ذَاتَ غَدَاةٍ : «إِنَّهُ أَتَانِيَ اللَّيْلَةَ آتِيَانِ، وَإِنَّهُمَا قَالاَ لِي : انْطَلِقْ، وَإِنِّي انْطَلَقتُ مَعَهُمَا، وَإِنَّا أَتَيْنَا عَلَى رَجُلٍ مُضْطَجِعٍ، وَإِذَا آخَرُ قائِمٌ عَلَيْهِ بِصَخْرَةٍ، وَإِذَا هُوَ يَهْوِي بِالصَّخْرَةِ لِرَأْسِهِ، فَيَثْلَغُ رَأسَهُ، فَيَتَدَهْدَهُ الحَجَرُ هَاهُنَا، فَيَتْبَعُ الحَجَرَ فَيَأْخُذُهُ فَلاَ يَرْجِعُ إِلَيْهِ حَتَّى يَصِحَّ رَأسُهُ كَمَا كَانَ، ثُمَّ يَعُودُ عَلَيْهِ، فَيَفْعَلُ بِهِ مِثْلَ مَا فَعَلَ المَرَّةَ الأوْلَى!» قَالَ: «قُلْتُ لَهُمَا : سُبْحانَ اللهِ ! مَا هَذَانِ ؟ قَالاَ لِي : انْطَلِقِ انْطَلِقْ، فَانْطَلَقْنَا، فَأَتَيْنَا عَلَى رَجُلٍ مُسْتَلْقٍ لِقَفَاهُ، وَإِذَا آخَرُ قَائِمٌ عَلَيْهِ بِكَلُّوبٍ مِنْ حَديدٍ، وَإِذَا هُوَ يَأتِي أَحَدَ شِقَّيْ وَجْهِهِ فَيُشَرْشِرُ شِدْقَهُ إِلَى قَفَاهُ، وَمِنْخَرَهُ إِلَى قَفَاهُ، وَعَيْنَهُ إِلَى قَفَاهُ، ثُمَّ يَتَحَوَّلُ إِلَى الجَانِبِ الآخَرِ، فَيَفْعَلُ بِهِ مِثْلَ مَا فَعَلَ بِالجَانِبِ الأَوَّلِ، فَمَا يَفْرَغُ مِنْ ذَلِكَ الجَانِبِ حَتَّى يَصِحَّ ذَلِكَ الجانبُ كَمَا كَانَ، ثُمَّ يَعُودُ عَلَيْهِ فَيَفْعَلُ مِثْلَ مَا فَعَلَ فِي المرَّةِ الأُوْلَى» قَالَ: «قُلْتُ : سُبْحَانَ اللهِ! مَا هَذَانِ ؟ قَالاَ لِي : انْطَلِقِ انْطَلِقْ، فَانْطَلَقْنَا، فَأَتَيْنَا عَلَى مِثْلِ التَّنُّورِ» فَأَحْسِبُ أنَّهُ قَالَ: «فَإِذَا فِيهِ لَغَطٌ، وَأَصْوَاتٌ، فَاطَّلَعْنَا فِيهِ فَإِذَا فِيهِ رِجَالٌ وَنِساءٌ عُرَاةٌ، وَإِذَا هُمْ يَأتِيهِمْ لَهَبٌ مِنْ أَسْفَلَ مِنْهُمْ، فَإِذَا أَتَاهُمْ ذَلِكَ اللَّهَبُ ضَوْضَوْا . قُلْتُ : مَا هَؤُلاَءِ ؟ قَالاَ لِي : انْطَلِقِ انْطَلِقْ، فَانْطَلَقْنَا، فَأَتَيْنَا عَلَى نَهْرٍ» حَسِبْتُ أَنَّهُ كَانَ يَقُوْلُ : «أَحْمَرُ مِثْلُ الدَّمِ، وَإِذَا فِي النَّهْرِ رَجُلٌ سَابِحٌ يَسْبَحُ، وَإِذَا عَلَى شَطِّ النَّهْرِ رَجُلٌ قَدْ جَمَعَ عِنْدَهُ حِجَارَةً كَثِيرَةً، وَإِذَا ذَلِكَ السَّابِحُ يَسْبَحُ، مَا يَسْبَحُ، ثُمَّ يَأتِي ذَلِكَ الَّذِي قَدْ جَمَعَ عِنْدَهُ الحِجَارَةَ، فَيَفْغَرُ لَهُ فَاهُ، فَيُلْقِمُهُ حَجَراً، فَينْطَلِقُ فَيَسْبَحُ، ثُمَّ يَرْجِعُ إِلَيْهِ، كُلَّمَا رَجَعَ إِلَيْهِ، فَغَرَ لَهُ فَاهُ، فَأَلْقَمَهُ حَجَراً، قُلْتُ لَهُمَا : مَا هَذَانِ ؟ قَالاَ لِي: انْطَلِقِ انْطَلِقْ، فَانْطَلَقْنَا، فَأَتَيْنَا عَلَى رَجُلٍ كَرِيهِ المَرْآةِ، أَوْ كَأَكْرَهِ مَا أَنْتَ رَاءٍ رَجُلاً مَرْأىً، فَإِذَا هُوَ عِنْدَهُ نَارٌ يَحُشُّهَا وَيَسْعَى حَوْلَهَا . قُلْتُ لَهُمَا : مَا هَذَا ؟ قَالاَ لي : انْطَلِقِ انْطَلِقْ، فَانْطَلَقْنَا، فَأتَيْنَا عَلَى رَوْضَةٍ مُعْتَمَّةٍ فِيهَا مِنْ كُلِّ نَوْرِ الرَّبيعِ، وَإِذَا بَيْنَ ظَهْرَي الرَّوْضَةِ رَجُلٌ طَويلٌ لاَ أَكَادُ أَرَى رَأسَهُ طُولاً فِي السَّماءِ، وَإِذَا حَوْلَ الرَّجُلِ مِنْ أَكْثَرِ وِلدَانٍ رَأيْتُهُمْ قَطُّ، قُلْتُ : مَا هَذَا ؟ وَمَا هَؤُلاَءِ ؟ قَالاَ لِي : انْطَلقِ انْطَلقْ، فَانْطَلَقْنَا، فَأَتَيْنَا إِلَى دَوْحَةٍ عَظيمةٍ لَمْ أَرَ دَوْحَةً قَطُّ أَعْظَمَ مِنْهَا، وَلاَ أَحْسَنَ ! قَالاَ لِي : اِرْقَ فِيهَا، فَارْتَقَيْنَا فِيهَا إِلَى مَدِينَةٍ مَبْنِيَّةٍ بِلَبنٍ ذَهَبٍ وَلَبنٍ فِضَّةٍ، فَأَتَيْنَا بَابَ المَدِينَةِ فَاسْتَفْتَحْنَا، فَفُتِحَ لَنَا فَدَخَلْنَاهَا، فَتَلَقَّانَا رِجَالٌ شَطْرٌ مِنْ خَلْقِهِمْ كَأَحْسَنِ مَا أَنتَ رَاءٍ ! وَشَطْرٌ مِنْهُمْ كَأقْبَحِ مَا أَنتَ رَاءٍ ! قَالاَ لَهُمْ : اِذْهَبُوا فَقَعُوا فِي ذَلِكَ النَّهْرِ، وَإِذَا هُوَ نَهْرٌ مُعْتَرِضٌ يَجْرِي كَأَنَّ مَاءَهُ المَحْضُ فِي البَيَاضِ، فَذَهَبُوا فَوَقَعُوا فِيهِ . ثُمَّ رَجَعُوا إِلَيْنَا قَدْ ذَهَبَ ذَلِكَ السُّوءُ عَنْهُمْ، فَصَارُوا فِي أَحْسَنِ صُورَةٍ» قَالَ: «قَالاَ لِي : هَذِهِ جَنَّةُ عَدْنٍ، وَهَذَاكَ مَنْزِلُكَ، فَسَمَا بَصَرِي صُعُداً، فَإِذَا قَصْرٌ مِثْلُ الرَّبَابَةِ البَيضَاءِ، قَالاَ لِي : هَذَاكَ مَنْزِلُكَ ؟ قُلْتُ لَهُمَا: بَارَكَ اللهُ فِيكُمَا، فَذَرَانِي فَأَدخُلَهُ . قَالاَ لِي : أَمَّا الآنَ فَلاَ، وَأَنتَ دَاخِلُهُ، قُلْتُ لَهُمَا : فَإِنِّي رَأَيتُ مُنْذُ اللَّيْلَةِ عَجَباً ؟ فَمَا هَذَا الَّذِي رَأَيْتُ ؟ قَالاَ لِي : أَمَا إِنَّا سَنُخْبِرُكَ : أَمَّا الرَّجُلُ الأوَّلُ الَّذِي أَتَيْتَ عَلَيْهِ يُثْلَغُ رَأسُهُ بِالحَجَرِ، فَإِنَّهُ الرَّجُلُ يَأخُذُ القُرآنَ فَيَرفُضُهُ، وَيَنَامُ عَنِ الصَّلاةِ المَكتُوبَةِ . وَأَمَّا الرَّجُلُ الَّذِي أَتَيْتَ عَلَيْهِ يُشَرْشَرُ شِدْقُهُ إِلَى قَفَاهُ، ومِنْخَرُهُ إِلَى قَفَاهُ، وَعَيْنُهُ إِلَى قَفَاهُ، فَإِنَّهُ الرَّجُلُ يَغْدُو مِنْ بَيْتِهِ فَيَكْذِبُ الكِذْبَةَ تَبْلُغُ الآفَاقَ . وَأَمَّا الرِّجَالُ وَالنِّسَاءُ العُرَاةُ الَّذِينَ هُمْ فِي مِثْلِ بِنَاءِ التَّنُّورِ، فَإِنَّهُمُ الزُّنَاةُ وَالزَّوَانِي، وَأَمَّا الرَّجُلُ الَّذِي أَتَيتَ عَلَيهِ يَسْبَحُ فِي النَّهْرِ، وَيُلقَمُ الحِجَارَةَ، فَإِنَّهُ آكِلُ الرِّبَا، وأمَّا الرَّجُلُ الكَريهُ الْمَرْآةِ الَّذِي عِنْدَ النَّارِ يَحُشُّهَا وَيَسْعَى حَوْلَهَا، فَإِنَّهُ مَالِكٌ خازِنُ جَهَنَّمَ، وَأَمَّا الرَّجُلُ الطَّوِيلُ الَّذِي فِي الرَّوْضَةِ، فَإِنَّهُ إِبرَاهِيم عليه السلام، وَأمَّا الولدَانِ الَّذِينَ حَوْلَهُ، فَكُلُّ مَوْلُودٍ مَاتَ عَلَى الفِطْرَةِ» وَفِي رِوَايَةِ البَرْقَانِيِّ : «وُلِدَ عَلَى الفِطْرَةِ» فَقَالَ بعض المُسلمينَ: يَا رَسُولَ اللهِ، وَأَولاَدُ المُشرِكِينَ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: «وَأَولاَدُ المُشرِكِينَ، وَأَمَّا القَوْمُ الَّذِينَ كَانُوا شَطْرٌ مِنْهُمْ حَسَنٌ، وَشَطْرٌ مِنْهُمْ قَبِيحٌ، فَإِنَّهُمْ قَومٌ خَلَطُوا عَمَلاً صَالِحاً وَآخَرَ سَيِّئاً، تَجَاوَزَ اللهُ عَنهُمْ» . رواه البخاري
৫/১৫৫৪। সামুরাহ ইবনে জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায়ই তাঁর সাহাবীদেরকে বলতেন, ‘‘তোমাদের কেউ কোন স্বপ্ন দেখেছে কি?’’ রাবী বলেন, যার ব্যাপারে আল্লাহর ইচ্ছা সে তাঁর কাছে স্বপ্ন বর্ণনা করত। তিনি একদিন সকালে বললেন, ‘‘গতরাত্রে আমার কাছে দুজন আগন্তুক এলো।

তারা আমাকে উঠাল, আর বলল, ‘চলুন।’ আমি তাদের সাথে চলতে লাগলাম। অতঃপর আমরা কাত হয়ে শোয়া এক ব্যক্তির নিকট পৌঁছলাম। দেখলাম, অপর এক ব্যক্তি তার নিকট পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার মাথায় পাথর নিক্ষেপ করছে। ফলে তার মাথা ফাটিয়ে ফেলছে। আর পাথর গড়িয়ে সরে পড়ছে। তারপর আবার সে পাথরটির অনুসরণ করে তা পুনরায় নিয়ে আসছে। ফিরে আসতে না আসতেই লোকটির মাথা আগের মত পুনরায় ভাল হয়ে যাচ্ছে। ফিরে এসে আবার একই আচরণ করছে; যা প্রথমবার করেছিল। [তিনি বলেন,] আমি সাথী-দ্বয়কে বললাম, ‘সুবহানাল্লাহ! এটা কি?’ তারা আমাকে বলল, ‘চলুন, চলুন।’

সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম, তারপর চিত হয়ে শোয়া এক ব্যক্তির কাছে পৌঁছলাম। এখানেও দেখলাম, তার নিকট এক ব্যক্তি লোহার আঁকড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর সে তার চেহারার একদিকে এসে এর দ্বারা তার কশ থেকে মাথার পিছনের দিক পর্যন্ত এবং একইভাবে নাকের ছিদ্র থেকে মাথার পিছনের দিক পর্যন্ত এবং অনুরূপভাবে চোখ থেকে মাথার পিছন দিক পর্যন্ত চিরে ফেলছে। তারপর ঐ লোকটি শোয়া ব্যক্তির অপরদিকে যাচ্ছে এবং প্রথম দিকের সাথে যেরূপ আচরণ করেছে অনুরূপ আচরণই অপর দিকের সাথেও করছে। ঐ দিক হতে অবসর হতে না হতেই প্রথম দিকটি আগের মত ভাল হয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার প্রথম বারের মত আচরণ করছে। [তিনি বলেন,] আমি বললাম, ‘সুবহানাল্লাহ! এরা কারা?’ তারা আমাকে বলল, ‘চলুন, চলুন।’

সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং [তন্দুর] চুলার মত একটি গর্তের কাছে পৌঁছলাম। [বর্ণনাকারী বলেন, আমার মনে হয়, যেন তিনি বললেন,] আর সেখানে শোরগোল ও নানা শব্দ ছিল। আমরা তাতে উঁকি মেরে দেখলাম, তাতে বেশ কিছু উলঙ্গ নারী-পুরুষ রয়েছে। আর নীচ থেকে নির্গত আগুনের লেলিহান শিখা তাদেরকে স্পর্শ করছে। যখনই লেলিহান শিখা তাদেরকে স্পর্শ করছে, তখনই তারা উচ্চরবে চিৎকার করে উঠছে। আমি বললাম, ‘এরা কারা?’ তারা আমাকে বলল, ‘চলুন, চলুন।’

সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং একটি নদীর কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। [বর্ণনাকারী বলেন, আমার যতদূর মনে পড়ে, তিনি বললেন,] নদীটি ছিল রক্তের মত লাল। আর দেখলাম, সেই নদীতে এক ব্যক্তি সাঁতার কাটছে। আর নদীর তীরে অপর এক ব্যক্তি রয়েছে এবং সে তার কাছে অনেকগুলো পাথর একত্রিত করে রেখেছে। আর ঐ সাঁতার-রত ব্যক্তি বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কাটার পর সেই ব্যক্তির কাছে ফিরে আসছে, যে তার নিকট পাথর একত্রিত করে রেখেছে। সেখানে এসে সে তার সামনে মুখ খুলে দিচ্ছে এবং ঐ ব্যক্তি তার মুখে একটি পাথর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তারপর সে চলে গিয়ে আবার সাঁতার কাটছে এবং আবার তার কাছে ফিরে আসছে।

আর যখনই ফিরে আসছে তখনই ঐ ব্যক্তি তার মুখে পাথর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এরা কারা?’ তারা বলল, ‘চলুন, চলুন।’
সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং এমন একজন কুৎসিত ব্যক্তির কাছে এসে পৌঁছলাম, যা তোমার দৃষ্টিতে সর্বাধিক কুৎসিত বলে মনে হয়। আর দেখলাম, তার নিকট রয়েছে আগুন, যা সে জ্বালাচ্ছে ও তার চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঐ লোকটি কে?’ তারা বলল, ‘চলুন, চলুন।’

সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং একটা সবুজ-শ্যামল বাগানে এসে উপস্থিত হলাম। সেখানে বসন্তের সব রকমের ফুল রয়েছে আর বাগানের মাঝে এত বেশী দীর্ঘকায় একজন পুরুষ রয়েছে, আকাশে যার মাথা যেন আমি দেখতেই পাচ্ছিলাম না। আবার দেখলাম, তার চারদিকে এত বেশী পরিমাণ বালক-বালিকা রয়েছে, যত বেশী পরিমাণ আর কখনোও আমি দেখিনি। আমি তাদেরকে বললাম, ‘উনি কে? এরা কারা?’ তারা আমাকে বলল, ‘চলুন, চলুন।’

সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং একটা বিশাল [বাগান বা] গাছের নিকট গিয়ে উপস্থিত হলাম। এমন বড় এবং সুন্দর [বাগান বা] গাছ আমি আর কখনো দেখিনি। তারা আমাকে বলল, ‘এর উপরে ছড়ুন।’ আমরা উপরে ছড়লাম। শেষ পর্যন্ত সোনা-রূপার ইটের তৈরি একটি শহরে গিয়ে আমরা উপস্থিত হলাম। আমরা শহরের দরজায় পৌঁছলাম এবং দরজা খুলতে বললাম। আমাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হল। আমরা তাতে প্রবেশ করলাম।

তখন সেখানে কতক লোক আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করল, যাদের অর্ধেক শরীর এত সুন্দর ছিল, যত সুন্দর তুমি দেখেছ, তার থেকেও অধিক। আর অর্ধেক শরীর এত কুৎসিত ছিল যত কুৎসিত তুমি দেখেছ, তার থেকেও অধিক। সাথী-দ্বয় ওদেরকে বলল, ‘যাও ঐ নদীতে গিয়ে নেমে পড়।’ আর সেটা ছিল সুপ্রশস্ত প্রবহমান নদী। তার পানি যেন ধপধপে সাদা।

ওরা তাতে গিয়ে নেমে পড়ল। অতঃপর ওরা আমাদের কাছে ফিরে এলো। দেখা গেল, তাদের ঐ কুশ্রী রূপ দূর হয়ে গেছে এবং তারা খুবই সুন্দর আকৃতির হয়ে গেছে। [তিনি বলেন,] তারা আমাকে বলল, ‘এটা জান্নাতে আদ্ন এবং ওটা আপনার বাসস্থান।’ [তিনি বলেন,] উপরের দিকে আমার দৃষ্টি গেলে, দেখলাম ধপধপে সাদা মেঘের মত একটি প্রাসাদ রয়েছে। তারা আমাকে বলল, ‘ঐটা আপনার বাসগৃহ।’ [তিনি বললেন,] আমি তাদেরকে বললাম, ‘আল্লাহ তোমাদের মাঝে বরকত দিন, আমাকে ছেড়ে দাও; আমি এতে প্রবেশ করি।’ তারা বলল, ‘আপনি অবশ্যই এতে প্রবেশ করবেন। তবে এখন নয়।’

আমি বললাম, ‘আমি রাতে অনেক বিস্ময়কর ব্যাপার দেখতে পেলাম, এগুলোর তাৎপর্য কি?’ তারা আমাকে বলল, ‘আচ্ছা আমরা আপনাকে বলে দিচ্ছি। ঐ যে প্রথম ব্যক্তিকে যার কাছে আপনি পৌঁছলেন, যার মাথা পাথর দিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হচ্ছিল, সে হল ঐ ব্যক্তি যে কুরআন গ্রহণ করে—তা বর্জন করে। আর ফরয নামায ছেড়ে ঘুমিয়ে থাকে।

আর ঐ ব্যক্তি যার কাছে গিয়ে দেখলেন যে, তার কশ থেকে মাথার পিছনের দিক পর্যন্ত এবং একইভাবে নাকের ছিদ্র থেকে মাথার পিছনের দিক পর্যন্ত এবং অনুরূপভাবে চোখ থেকে মাথার পিছন দিক পর্যন্ত চিরে ফেলা হচ্ছিল। সে হল ঐ ব্যক্তি যে সকালে আপন ঘর থেকে বের হয়ে এমন মিথ্যা বলে, যা চতুর্দিক ছড়িয়ে পড়ে।

আর যে সকল উলঙ্গ নারী-পুরুষ যারা [তন্দুর] চুলা সদৃশ গর্তের অভ্যন্তরে রয়েছে, তারা হল ব্যভিচারী-ব্যভিচারিণীর দল।

আর ঐ ব্যক্তি যার কাছে পৌঁছে দেখলেন যে, সে নদীতে সাঁতার কাটছে ও তার মুখে পাথর ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে সে হল সুদখোর।

আর ঐ কুৎসিত ব্যক্তি যে আগুনের কাছে ছিল এবং আগুন জ্বালাচ্ছিল আর তার চারপাশে ছুটে বেড়াচ্ছিল। সে হল মালেক [ফিরিস্তা]; জাহান্নামের দারোগা।

আর ঐ দীর্ঘকায় ব্যক্তি যিনি বাগানে ছিলেন। তিনি হলেন ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম। আর তাঁর চারপাশে যে বালক-বালিকারা ছিল, ওরা হল তারা, যারা [ইসলামী] প্রকৃতি নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।’’

বারক্বানীর বর্ণনায় আছে, ‘‘ওরা তারা, যারা [ইসলামী] প্রকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে [মৃত্যুবরণ করেছে]।’’ তখন কিছু সংখ্যক মুসলিম জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! মুশরিকদের শিশু-সন্তানরাও কি [সেখানে আছে]?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘মুশরিকদের শিশু-সন্তানরাও [সেখানে আছে]।

আর ঐ সব লোক যাদের অর্ধেকাংশ অতি সুন্দর ও অর্ধেকাংশ অতি কুৎসিত ছিল, তারা হল ঐ সম্প্রদায় যারা সৎ-অসৎ উভয় প্রকারের কাজ মিশ্রিত-ভাবে করেছে। আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।’’ (বুখারী)

অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘‘আজ রাতে আমি দেখলাম, দু’টি লোক এসে আমাকে পবিত্র ভূমির দিকে বের করে নিয়ে গেল।’’ অতঃপর ঘটনা বর্ণনা করলেন। তিনি বললেন, ‘‘সুতরাং আমরা চলতে লাগলাম এবং [তন্দুর] চুলার মত একটি গর্তের কাছে পৌঁছলাম; যার উপর দিকটা সংকীর্ণ ছিল এবং নিচের দিকটা প্রশস্ত। তার নিচে আগুন জ্বলছিল। তার মধ্যে উলঙ্গ বহু নারী-পুরুষ ছিল। আগুন যখন উপর দিকে উঠছিল, তখন তারাও [আগুনের সাথে] উপরে উঠছিল। এমনকি প্রায় তারা [চুলা] থেকে বের হওয়ার উপক্রম হচ্ছিল। আর যখন আগুন স্তিমিত হয়ে নেমে যাচ্ছিল, তখন [তার সাথে] তারাও নিচে ফিরে যাচ্ছিল।’’

এই বর্ণনায় আছে, ‘‘একটি রক্তের নদীর কাছে এলাম।’’ বর্ণনাকারী এতে সন্দেহ করেননি। ‘‘সেই নদীর মাঝখানে একটি লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর নদীর তীরে একটি লোক রয়েছে, যার সামনে পাথর রয়েছে। অতঃপর নদীর মাঝের লোকটি যখন উঠে আসতে চাচ্ছে, তখন তীরের লোকটি তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে সেই দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে যেখানে সে ছিল। এইভাবে যখনই সে নদী থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে, তখনই ঐ লোকটি তার মুখে পাথর ছুঁড়ে মারছে। ফলে সে যেখানে ছিল সেখানে ফিরে যাচ্ছে।’’
এই বর্ণনায় আরও আছে, ‘‘তারা উভয়ে আমাকে নিয়ে ঐ [বাগান বা] গাছে উঠে গেল। অতঃপর সেখানে এমন একটি গৃহে আমাকে প্রবেশ করাল, যার চেয়ে অধিক সুন্দর গৃহ আমি কখনো দেখিনি। সেখানে বহু বৃদ্ধ ও যুবক লোক ছিল।’’

এই বর্ণনায় আরও আছে, ‘‘আর যাকে আপনি তার নিজ কশ চিরতে দেখলেন, সে হল বড় মিথ্যুক; যে মিথ্যা কথা বলত, অতঃপর তা তার নিকট থেকে বর্ণনা করা হত। ফলে তা দিকচক্রবালে পৌঁছে যেত। অতএব এই আচরণ তার সাথে কিয়ামত পর্যন্ত করা হবে।’’

এই বর্ণনায় আরও আছে, ‘‘যার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে দেখলেন, সে ছিল এমন ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ কুরআন শিখিয়েছিলেন। কিন্তু সে [তা ভুলে] রাতে ঘুমিয়ে থাকত এবং দিনে তার উপর আমল করত না। অতএব এই আচরণ তার সাথে কিয়ামত পর্যন্ত করা হবে।

আর প্রথম যে গৃহটি আপনি দেখলেন, তা হল সাধারণ মুমীনদের। পক্ষান্তরে এই গৃহটি হল শহীদদের। আমি জিবরীল, আর ইনি মীকাঈল। অতএব আপনি মাথা তুলুন। সুতরাং আমি মাথা তুললাম। তখন দেখলাম, আমার উপর দিকে মেঘের মত কিছু রয়েছে। তাঁরা বললেন, ‘ওটি হল আপনার গৃহ।’ আমি বললাম, ‘আপনারা আমাকে ছেড়ে দিন, আমি আমার গৃহে প্রবেশ করি।’ তাঁরা বললেন, ‘[দুনিয়াতে] আপনার আয়ু অবশিষ্ট আছে; যা আপনি পূর্ণ করেননি। যখন আপনি তা পূর্ণ করবেন, তখন আপনি আপনার গৃহে চলে আসবেন।’’ (বুখারী) [5]

* [প্রকাশ থাকে যে, হাদীসে উক্ত মিথ্যাবাদীদের দলে তারা পড়তে পারে, যারা প্রচার মাধ্যমে; রেডিও, টিভি প্রভৃতিতে মিথ্যা বলে। কারণ তাদের মিথ্যা কথা দিকচক্রবালে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।]

বৈধ মিথ্যা
========

জেনে রাখুন যে, নিঃসন্দেহে মিথ্যা বলা মূলত: যদিও হারাম তবুও কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশেষ শর্তসাপেক্ষে তা বৈধ। যার ব্যাপারে আমি আমার ‘কিতাবুল আযকার’ নামক পুস্তকে বিস্তৃতভাবে আলোকপাত করেছি। যার সার-সংক্ষেপ এই যে, কথাবার্তা উদ্দেশ্য সফল হওয়ার অন্যতম মাধ্যম। সুতরাং কোন সৎ উদ্দেশ্য যদি মিথ্যার আশ্রয় ব্যতিরেকে সাধন সম্ভবপর হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া বৈধ নয়। পক্ষান্তরে সে সৎ উদ্দেশ্য যদি মিথ্যা বলা ছাড়া সাধন সম্ভব না হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা বৈধ। পরন্তু যদি বাঞ্ছিত লক্ষ্য বৈধ পর্যায়ের হয়, তাহলে মিথ্যা বলা বৈধ হবে। আর যদি অভীষ্ট লক্ষ্য ওয়াজেবের পর্যায়ভুক্ত হয়, তাহলে তা অর্জনের জন্য মিথ্যা বলাও ওয়াজেব হবে।

যেমন কোন মুসলিম এমন অত্যাচারী থেকে আত্মগোপন করেছে, যে তাকে হত্যা করতে চায় অথবা তার মাল-ধন ছিনিয়ে নিতে চায় এবং সে তা লুকিয়ে রেখেছে। এখন যদি কেউ তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয় [যে তার ঠিকানা জানে], তাহলে সে ক্ষেত্রে তাকে গোপন [ও নিরাপদ] রাখার জন্য তার পক্ষে মিথ্যা বলা ওয়াজেব।

অনুরূপভাবে যদি কারো নিকট অপরের আমানত থাকে, আর কোন জালেম যদি তা বলপূর্বক ছিনিয়ে নিতে চায়, তাহলে তা গোপন করার জন্য মিথ্যা বলা ওয়াজেব। অবশ্য এ সমস্ত বিষয়ে সরাসরি স্পষ্টাক্ষরে মিথ্যা না বলে ‘তাওরিয়াহ’ করার পদ্ধতি অবলম্বন করাই উত্তম।

‘তাওরিয়াহ’ হল এমন বাক্য ব্যবহার করা, যার অর্থ ও উদ্দেশ্য শুদ্ধ তথা তাতে সে মিথ্যাবাদী নয়; যদিও বাহ্যিক শব্দার্থে এবং সম্বোধিত ব্যক্তির বুঝ মতে সে মিথ্যাবাদী হয়। পক্ষান্তরে যদি উক্ত পরিস্থিতিতে ‘তাওরিয়াহ’ পরিহার করে প্রকাশ্যভাবে মিথ্যা বলা হয়, তবুও তা হারাম নয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মিথ্যা বলার বৈধতার প্রমাণে উলামায়ে কিরাম উম্মে কুলসুম কর্তৃক বর্ণিত হাদিসটি পেশ করেন।

উম্মে কুলসুম রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন যে, ‘‘লোকের মধ্যে সন্ধি স্থাপনকারী মিথ্যাবাদী নয়। সে হয় ভাল কথা পৌঁছায়, না হয় ভাল কথা বলে।’’ (বুখারী ও মুসলিম)

মুসলিমে আছে উম্মে কুলসুম রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, তাঁকে মানুষের কথাবার্তায় মিথ্যা বলার অনুমতি দিতে শুনিনি, তিন ক্ষেত্র ছাড়া:

[১] যুদ্ধকালে

[২] লোকদের ঝগড়া মিটাবার ক্ষেত্রে ও

[৩] স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের [প্রেম বর্ধক] কথোপকথনে।

কথাবার্তা বলা ও বর্ণনা করার সময় যাচাই-তদন্ত করে সাবধানে করার প্রতি উৎসাহ দান

মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ وَلَا تَقۡفُ مَا لَيۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٌۚ ﴾ [الاسراء: ٣٦]
অর্থাৎ যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই সেই বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না। (সূরা ইসরা ৩৬ আয়াত)
তিনি বলেছেন,
﴿ مَّا يَلۡفِظُ مِن قَوۡلٍ إِلَّا لَدَيۡهِ رَقِيبٌ عَتِيدٞ ١٨ ﴾ [ق: ١٨]
অর্থাৎ মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করুক না কেন, তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে। [ক্বাফ ১৮ আয়াত)
[এ মর্মে মহান আল্লাহর এ বাণীও অনেকে উল্লেখ করে থাকেন, ‘‘হে ঈমানদারগণ! যদি কোন পাপাচারী তোমাদের নিকট কোন বার্তা আনয়ন করে, তাহলে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখ; যাতে অজ্ঞতাবশত: তোমরা কোন সম্প্রদায়কে আঘাত না কর এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।’’ – সূরা হুজুরাত ৬ আয়াত)

হাদীসসমূহ:

1/1555 وَعَنْ أَبي هُرَيرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ: «كَفَى بِالمَرْءِ كَذِباً أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ». رواه مسلم
১/১৫৫৫। আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা কিছু শোনে [বিনা বিচারে] তা-ই বর্ণনা করে।’’ (মুসলিম) [6]

2/1556 وَعَنْ سَمُرَةَ رضي الله عنه قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: «مَنْ حَدَّثَ عَنِّي بِحَدِيثٍ يَرَى أَنَّهُ كَذِبٌ فَهُوَ أَحَدُ الكَاذِبَينَ» . رواه مسلم
২/১৫৫৬। সামুরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি আমার তরফ থেকে কোন হাদিস বর্ণনা করে অথচ সে জানে যে, তা মিথ্যা, তবে সে দুই মিথ্যুকের একজন।’’ (মুসলিম)[7]

3/1557 وَعَنْ أَسْمَاءَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا : أَنَّ امْرأةً قَالَتْ : يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّ لِي ضَرَّةً فَهَلْ عَلَيَّ جُنَاحٌ إِنْ تَشَبَّعْتُ مِنْ زَوْجِي غَيْرَ الَّذِي يُعْطِينِي ؟ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم المُتَشَبِّعُ بِما لَمْ يُعْطَ كَلاَبِسِ ثَوْبَيْ زُورٍ». متفق عَلَيْهِ
৩/১৫৫৭। আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, একটি মহিলা বলল, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার এক সতীন আছে, সুতরাং স্বামী আমাকে যা দেয় না, তা নিয়ে যদি পরিতৃপ্তি প্রকাশ করি, তাতে আমার কোন ক্ষতি হবে কি?’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘যা দেওয়া হয়নি, তা নিয়ে পরিতৃপ্তি প্রকাশকারী মিথ্যা দুই বস্ত্র পরিধানকারীর ন্যায়।’’ (বুখারী ও মুসলিম)[8]

‘পরিতৃপ্তি প্রকাশকারী’ যে প্রকাশ করে যে, সে পরিতৃপ্ত, অথচ আসলে সে তা নয়। এখানে উদ্দেশ্য হল, যে প্রকাশ করে যে, সে মর্যাদা লাভ করেছে, অথচ সে তা লাভ করেনি। আর ‘মিথ্যা দুই বস্ত্র পরিধানকারী’ হল সেই, যে লোকচক্ষুতে মেকী সাজে। লোককে ধোঁকা দেওয়ার জন্য সংসার-বিরাগী, আলেম অথবা ধনবান ব্যক্তির পোশাক পরিধান করে, অথচ সে তা নয়। এ ছাড়া অন্য কিছুও বলা হয়েছে। আর আল্লাহই অধিক জানেন।

মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ

মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ وَٱجۡتَنِبُواْ قَوۡلَ ٱلزُّورِ ٣٠ ﴾ [الحج : ٣٠]
অর্থাৎ তোমরা মিথ্যা কথন থেকে দূরে থাক। (সূরা হজ্জ ৩০ আয়াত)
তিনি আরও বলেন,
﴿ وَلَا تَقۡفُ مَا لَيۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٌۚ ﴾ [الاسراء: ٣٦]
অর্থাৎ যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই সেই বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না। (সূরা ইসরা ৩৬ আয়াত)
তিনি আরও বলেছেন,
﴿ مَّا يَلۡفِظُ مِن قَوۡلٍ إِلَّا لَدَيۡهِ رَقِيبٌ عَتِيدٞ ١٨ ﴾ [ق: ١٨]
অর্থাৎ মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করুক না কেন তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে। [ক্বাফ ১৮ আয়াত)
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ إِنَّ رَبَّكَ لَبِٱلۡمِرۡصَادِ ١٤ ﴾ [الفجر: ١٤]
অর্থাৎ নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক সময়ের প্রতীক্ষায় থেকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। (সূরা ফাজর ১৬ আয়াত)
তিনি আরও বলেছেন,
﴿ وَٱلَّذِينَ لَا يَشۡهَدُونَ ٱلزُّورَ ﴾ [الفرقان: ٧٢]
অর্থাৎ [তারাই পরম দয়াময়ের দাস] যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না। (সূরা ফুরক্বান ৭২ আয়াত)

হাদীসসমূহ:

1/1558 وَعَنْ أَبي بَكْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْه قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الكَبَائِرِ ؟» قُلْنَا : بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ . قَالَ: «الإِشْرَاكُ بِاللهِ، وعُقُوقُ الوَالِدَيْنِ» وَكَانَ مُتَّكِئاً فَجَلَسَ، فَقَالَ: «أَلاَ وَقَولُ الزُّورِ» فَمَا زَالَ يُكَرِّرُهَا حَتَّى قُلنَا : لَيْتَهُ سَكَتَ. متفق عَلَيْهِ
১/১৫৫৮। আবূ বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘তোমাদেরকে কি অতি মহাপাপের কথা বলে দেব না?’’ আমরা বললাম, ‘অবশ্যই বলুন হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করা এবং মাতা-পিতার অবাধ্যাচরণ করা।’’ তারপর তিনি হেলান ছেড়ে উঠে বসলেন এবং বললেন, ‘‘শোন! আর মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।’’ শেষোক্ত কথাটি তিনি বারবার বলতে থাকলেন। এমনকি অনুরূপ বলাতে আমরা [মনে মনে] বললাম, ‘যদি তিনি চুপ হতেন।’ (বুখারী ও মুসলিম) [9]

[1] সহীহুল বুখারী ৬০৯৪, মুসলিম ২৬০৬, ২৬০৭, তিরমিযী ১৯৭১, আবূ দাউদ ৪৯৮৯, ইবনু মাজাহ ৪৬, আহমাদ ৩৫৩১, ৩৭১৯, ৩৮৩৫, ৩৮৮৬, ৪০১২, ৪০৮৪, ৪০৯৭, ৪১৭৬, মুওয়াত্তা মালিক ১৮৫৯, দারেমী ২৭১৫
[2] সহীহুল বুখারী ৩৪২, ৪৫৯, ৩১৭৮, মুসলিম ৫৮, তিরমিযী ২৬৩২, নাসায়ী ৫০২০, আবূ দাউদ ৪৬৮৮, আহমাদ ৬৭২৯, ৬৮২৫, ৬৮৪০
[3] সহীহুল বুখারী ২২২৫, ৫৯৬৩, ৭০৪২, মুসলিম ২১১০, তিরমিযী ১৭৫১, ২২৮৩, নাসায়ী ৫৩৫৮, ৫৩৫৯, আবূ দাউদ ৫০২৪, ইবনু মাজাহ ৩৯১৬, আহমাদ ১৮৬৯, ২১৬৩, ২২১৪, ২৮০৬, ৩২৬২, ৩৩৭৩, ৩৩৮৪, ২১৬৩
[4] সহীহুল বুখারী ৭০৪৩, আহমাদ ৫৬৭৮, ৫৯৬২
[5] মুসলিম ১৩৮৬, ৮৪৫, ১১৪৩, ২০৮৫, ২৭৯১, ৩২৩৬, ৩৩৫৪, ৪৬৭৪, ৬০৯৬, ৭০৪৭, মুসলিম ২২৭৫, তিরমিযী ২২৯৪, আহমাদ ১৯৫৯০, ১৯৫৯৫, ১৯৬৫২
[6] মুসলিম ৫, আবূ দাউদ ৪৯৯২
[7] সহীহুল বুখারী ১২৯১, তিরমিযী ২৬৬২, ইবনু মাজাহ ৩৯, ৪১, আহমাদ ১৭৭৩৭, ১৭৭৭৬, ১৯৬৫০, ১৯৭১২, মুসলিম [ভূমিকা)
[8] সহীহুল বুখারী ৫২১৯, মুসলিম ২১৩০, আবূ দাউদ ৪৯৯৭, আহমাদ ২৬৩৮১, ২৬৩৮৯, ২৬৪৩৭
[9] সহীহুল বুখারী ২৬৪৫, ৫৯৭৬, ৬২৭৩, ৬৯১৯, মুসলিম ৮৭, তিরমিযী ১৯০১, ২৩০১, ৩০১৯, আহমাদ ১৯৮৭২, ১৯৮৮১
_________________________________________________________________________________

সংকলন : ইমাম মুহিউদ্দীন আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবন শরফ আন-নাওয়াবী রহ.
হাদীসের শুদ্ধাশুদ্ধি নির্ণয় : শাইখ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ.
অনুবাদক : বিশিষ্ট আলেমবর্গ
অনুবাদ সম্পাদনা : আব্দুল হামীদ ফাইযী।