ভারতবর্ষে আহলে হাদীসদের প্রকৃত ইতিহাস

ভারতবর্ষে আহলে হাদীসদের প্রকৃত ইতিহাস

রচনায়: ওয়ার্ল্ড এসেম্বলি অফ মুসলিম ইয়োথ (WAMY)

অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

আহলে হাদীসের রিচয়:

ভারতবর্ষে প্রাচীনতম ইসলামী আন্দোলনের নাম হল আহলে হাদীস আন্দোলন। এই আন্দোলনের ভিত্তি হলসাহাবীতাবেঈ ও তাদের অনুসারী পূর্ববর্তী মনিষীদের বুঝ ও ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ করা এবং এই দুটো জিনিসকে আকীদা, ইবাদত, মুয়ামালাতনীতি-নৈতিকতারাজনীতি তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রে অন্য কোন মানুষের মতামতচিন্তা-চেতনা ও আদর্শের উপর অগ্রাধিকার দেয়া। সেই সাথে শিরকবিদআত ও সকল প্রকার অপসংস্কৃতি মূলোৎপাটনে কাজ করা।

ভারতবর্ষে আহলে হাদীসের প্রতিষ্ঠা ও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব:

ভারতবর্ষে আহলে হাদীস আন্দোলনের ইতিহাস ইসলামের সূচনা লগ্নের সাথে সম্পর্কিত। আরব বনিক ও মুজাহিদগণ ভরতের সমূদ্রতীরবর্তী কতিপয় অঞ্চল যেমনসিন্ধুমালাবার (বর্তমান কেরালা) ও গুজরাতে পৌঁছলে তাদের প্রচেষ্টায় সে সকল এলাকা ইসলামের আলোকে আলোকিত হয়ে উঠে। ফলে সিন্ধের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং মুলতানে আহলে হাদীসদের বেশ কিছু মারকায (কেন্দ্র) গড়ে উঠে এবং সেখানে আরব-অনারব মুহাদ্দিসগণ আগমন করেন।

বিখ্যাত পরিব্রাজক আবুল কসেম আল মাকদেসী ৩৭৫ হিজরীতে অত্র এলাকা পরিভ্রমণে এসে তার আহসানুত তাকাসীম গ্রন্থে সিন্ধের বিভিন্ন এলাকার ধর্মীয় অবস্থা বর্ণনা গিয়ে লিখেন:

সেখানকার অধিকাংশ জন-সাধারণের মাযহাব হল,তারা আহলে হাদীস। তবে গুটি কয়েক ফকীহ হানাফী মাযহাব থেকে মুক্ত ছিলেন না। সেখানকার অধিবাসীগণ সঠিক পথ,প্রশংসনীয় মাযহাব, নির্ভেজাল ও পরিচ্ছন্ন নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মযহাবী গোঁড়ামি, বাড়াবাড়ি ও ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে মুক্ত রেখেছিলেন।

হিজরী চতুর্থ শতকের শেষ দিকে এসে আহলে হাদীস আন্দোলনে দুর্বলতা শুরু হয় এবং হিজরী নবম শতকে এসে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। এর কারণ ছিলরাজনৈতিক দলাদলিগোঁড়ামিবাতেনী ইসমাঈলী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আহলে সুন্নতের উপর বিভিন্ন ধরণের ফিতনা-ফ্যাসাদ, তাক্বলীদ ও মাযহাবী গোঁড়ামিইউনানি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপকতা ইত্যাদি নানা সমস্যা।

কিন্তু এতদসত্বেও তখনও ভারত উপমহাদেশে ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ)ইমাম সাখাবী এবং শাইখুল ইসলাম জাকারিয়া আনসারী প্রমুখের বেশ কতিপয় আহলে হাদীস ছাত্র ও বিশিষ্ট আলেম বিদ্যমান ছিলেন যারা আহলে হাদীস মানহাজকে সংরক্ষণ করে যাচ্ছিলেন।

আধুনিক যুগে আহলে হাদীসঃ

হিজরী এগারো শতকের সূচনা লগ্নে শুরু হয় আহলে হাদীসদের নতুনভাবে পথ চলা।

শাইখ আহমদ সিন্ধ (মৃত্যু: ১০৩৪ হি:) এর মাধ্যমে এই আন্দোলন পুনর্জীবিত হয়। আর শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (মৃত্যু: ১১৭৫ হি:) এর জমানায় তা শক্তিশালী হয়। বিশেষ করে তার বড় ছেলে শাহ আব্দুল আযীয দেহলবী (জন্ম: ১১৫৯-মৃত্যু: ১২৩৯ হি:) এর জমানায় তা আরও শক্তিশালী রূপ পরিগ্রহ করে। তিনি দাওয়াততাবলীগতাদরীসতালীফ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর পিতার রীতি অনুসরণ করেন। তিনি মাযহাবী গোঁড়ামি ও দীনি গবেষণায় স্থবিরতা বর্জন করেন।

পর্যায়ক্রমে তাঁর নাতী দাওয়াত ও জিহাদের সিপাহসালার এবং বিখ্যাত তাকবিয়াতুল ঈমান গ্রন্থের লেখক আল্লামা শাহ ইসমাইল বিন আব্দুল গনী দেহলবী (মৃত্যু: ১২৪৩ হি:) এর সময় আহলে হাদীস আন্দোলন আরও শাক্তিশালী ভাবে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

বালাকোটের যুদ্ধে (মৃত্যু: ১২৪৩ হি:) ইমাম শাহ ইসমাইল (রহঃ) নিহত হলে আহলে হাদীসগণ পূর্ণ আমানত ও ইখলাসের সাথে দাওয়াত ও জিহাদের দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে তুলে নেয়।

এই পর্যায়ে তাদের কার্যক্রম মৌলিকভাবে তিনটি ময়দানে সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। সেগুলো হল, জিহাদতালীফ-তাসনীফ (বই-পুস্তক রচনা) এবং তাদরীস (শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ)।

১. জিহাদের ময়দানে আহলে হাদীসঃ

শাহ ইসমাইল দেহলবী (রহঃ) এর আন্দোলন কুরআন-সুন্নাহর উপর আমল করার আহ্বানকে পুনর্জীবন দান,খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নবুওয়াহ (নবুওয়তের ধারায় খিলাফত) প্রতিষ্ঠা, মাযহাবী গোঁড়ামি ও চিন্তা-ধারায় স্থবিরতা,বিদআত ও বাতিল আকীদাকে মূলোৎপাটন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তার জিহাদি আন্দোলন শিখ ও সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেছে। বিশেষ করে ভারতের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকা সমূহে তার সংগ্রাম বিশাল ভূমিকা পালন করেছে। ইংরেজগণ ১৯৪৭ খৃষ্টাব্দে ভারত থেকে বিতাড়িত হওয়া পর্যন্ত তার এ আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত ছিল।

অতঃপর ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পরেও তার নেতৃত্বে মুজাহিদগণ জিহাদ অব্যাহত রাখে এবং তাদের একটি বাহিনী মুযাফফরাবাদ শহর জয় করে।

শাইখ ফজল এলাহি ওযীরাবাদী এর নেতৃত্বে উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য কয়েকটি শহর অধিকৃত হয় যেগুলোর সমন্বয়ে বর্তমানে আজাদ কাশ্মীর গঠিত।

জিহাদের ময়দানে আরও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হল শাইখ বেলায়াত আলী সাদেকপুরী (মৃত্যু: ১২৬৯ হি:), তার ভাই এনায়েত আলী সাদেকপুরী (মৃত্যু: ১২৭৪ হি:) ও সাদেকপুরী পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ-যারা এই জিহাদের ঝাণ্ডাকে উড্ডীন রাখেন এবং এ ক্ষেত্রে তারা অনেক কষ্ট ও ত্যাগ তিতিক্ষা শিকার করেন।

২. তালীফ-তাসনীফ (বই-পুস্তক রচনা) এর ময়দানে আহলে হাদীসগণঃ

আহলে হাদীসগণ তা’লীফ-তাসনীফের মাধ্যমে ইসলামী সংস্কৃতির পুনর্জীবন দানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। উলূমুল কুরআনউলূমুল হাদীস, হাদীসের ভাষ্য গ্রন্থ রচনা, বিশুদ্ধ আকীদা ও তার বিরুদ্ধাচারণ কারীদের জবাববিদআত ও বাতিল আকীদা পন্থীদের প্রতিবাদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আহলে হাদীস আলেম ও মুহাদ্দিসগণ লিখনির মাধ্যমে পর্যাপ্ত ভূমিকা পালন করেন।

এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগণের মধ্যে অন্যতম হলেন,ভূপালের শাসক নওয়াব সিদ্দীক খান ভূপালী (মৃত্যু: ১৩০৭ হি:)। তিনি গ্রন্থ রচনা,গবেষণা, প্রকাশনা এবং হাদীসের বড় বড় কিতাব লিখনীতে বিশাল অবদান রাখেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি তিনশ’র অধিক গ্রন্থ রচনা করেন। জ্ঞান-গবেষণার পাশাপাশি তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এবং সালাফী আলেমগণের সমন্বয়ে বই-পুস্তক রচনাঅনুবাদ ও শিক্ষকতার জন্য একটি বোর্ড গঠন করেন এবং নিজ খরচে সালফে-সালেহীনের লিখিত বই পুস্তক বিশেষ করে আকীদার মূলনীতি,তাফসীর ও হাদীসের গ্রন্থাদি প্রকাশ ও বিতরণের জন্য কয়েকটি ছাপাখানা তৈরি করেন।

৩. দারস-তাদরীসের ময়দানে আহলে হাদীসঃ

দারস-তাদরীসের ময়দানে আহলে হাদীসগণ পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেন এবং দাওয়াহতাদরীসমাদরাসাজামেয়া ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হল. আল্লামা শাইখ নাজির হুসাইন মুহাদ্দিসে দেহলভী (মৃত্যু: ১৩২০ হি:)।

তিনি ছিলেন ভারত উপমহাদেশে ইলমে হাদীস চর্চায় পথিকৃৎ। তিনি দিল্লিতে প্রায় ৬০ বছর যাবত ইলমে হাদীস ও অন্যান্য দীনি বিষয়ে দারস ও তাদরীসের খেদমত আঞ্জাম দেন। পাশাপাশি তিনি সঠিক আকীদা ও বিশুদ্ধ ইসলামের দাওয়াতেও অবদান রাখেন।

বলা হয়ে থাকেতার সময়কালে প্রায় দুই মিলিয়ন মুসলিম শিরক-বিদআত থেকে তওবা করে সহীহ আকীদা গ্রহণ করে। এই মহা মনিষীর মাধ্যমে আধুনিক যুগের অনেক বড় বড় মুহাদ্দিস ও দাঈ তৈরি হয়। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন:

১) প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল্লাহ গজনবী (মৃত্যু: ১২৯৮ হি:)

২) শামসুল হক আযীমাবাদী (মৃত্যু: ১৩২৯ হি:) (সুনান আবু দাউদের ভাষ্য গ্রন্থ আউনুল মাবুদের প্রণেতা)

৩) আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (মৃত্যু: ১৩৫৭ হি:) (সুনানে তিরমিযীর ভাষ্য গ্রন্থ তুহফাতুল আহওয়াযী এর প্রণেতা)

৪) আল্লামা বাশীর সাহসাওয়ানী (মৃত্যু: ১৩২৬ হি:) (সিয়ানাতুল ইনসান আ’ন ওয়াসওয়াসাতিশ শাইখ দাহলান’ গ্রন্থের প্রণেতা)।

৫) শাইখ আব্দুল্লাহ বিন ইদরীস সানুসী মাগরিবী।

৬) শাইখ সাদ বিন হামাদ বিন আতীক নাজদী। যিনি তাঁর শাইখ আল্লামা নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিসে দেহলভীর হাদীসের সনদ হেজায ও নজদ সহ আরবের বিভিন্ন এলাকায় সম্প্রসারিত করেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায়ে নাযির হুসাইন দেহলভী অদ্যবধী দিল্লীতে বিদ্যমান রয়েছে। সেখান থেকে এখনও অনেক আলেম ও দায়ী ইলাল্লাহ বের হয়ে ইসলামের খেদমতে অবদান রাখছে।

জমঈয়ত আহলে হাদীস গঠনঃ

১৩২৪ হিজরী মোতাবেক ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে আহলে হাদীস আলেমগণ শাইখুল ইসলাম আবুল ওয়াফা সানাউল্লাহ আমৃতসরী (১৩৬৭ হি:) এর নেতৃত্বে এমন একটি জমঈয়ত (সংঘ) গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যার উদ্দেশ্য হলসালফে-সালেহীনের বুঝ অনুযায়ী কিতাব-সুন্নাহর প্রচারবিভিন্ন ইসলাম বিধ্বংসী আন্দোলন ও আধুনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা। যার নাম দেয়া হয়, ‘অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্স।’

১৯৪৭ খৃষ্টাব্দে উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পর আহলে হাদীস আন্দোলন সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। যার কারণে আহলে হাদীসদের সর্ব বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিল্লীর দারুল হাদীস রহমানিয়া তাদের হাত ছাড়া হয়ে যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে অনতিবিলম্বে নতুনভাবে ভারত ও পাকিস্তানে জমঈয়ত আহলে হাদীস গঠন করা হয়। ফলে জমঈয়তের হারানো শক্তি পুনরায় ফিরে আসে।

অতঃপর উভয় দেশের জমঈয়ত যুগের চাহিদা পূরণ ও সালাফে-সালেহীনের রীতির আলোকে কুরআন-সুন্নাহর পাঠ ও পঠনের নিমিত্তে বিভিন্ন মাদরাসাজামেয়া ও একাডেমী প্রতিষ্ঠা করে।

জমঈয়ত প্রতিষ্ঠিত কতিপয় উল্লেখযোগ্য জামেয়াঃ

ভারত:

  • জামেয়া সালাফিয়া বেনারস। এটি ভারতের মাটিতে আহলে হাদীসদের প্রতিষ্ঠিত সর্ববৃহৎ আরবী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকাল ১৩৮৩ হিজরী মোতাবেক ১৯৬৩ খৃষ্টাব্দ।
  • জামেয়া রহমানিয়া।
  • জামেয়া আহমদিয়া সালাফিয়া।
  • জামেয়া দারুস সালামউমরাবাদ।
  • জামেয়া সালাফিয়াকেরালা।
  • জামেয়া আল হিন্দকেরালা।
  • জামেয়া ইসলামিয়ামোম্বাই।
  • জামেয়া ইবনে তাইমিয়াবিহার।
  • জামেয়া ইমাম বুখারীবিহার ইত্যাদি।

পাকিস্তান:

  • জামেয়া সালাফিয়াফয়সালাবাদ। এটি হল ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত সর্ব বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৫১ খৃষ্টাব্দ।
  • জামেয়াতুল উলূমিল আসারিয়া, জালহাম।
  • জামেয়া আবু বকর সিদ্দীককরাচী।
  • জামেয়া মুহাম্মাদিয়াগুজরানাওয়ালা ইত্যাদি।

প্রকাশনার জগতে জমঈয়তে  আহলে হাদীস:

এছাড়াও জমঈয়তের পক্ষ থেকে অনেক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয় যেখানে বহু মূল্যবান ও বিরল গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি ও বই-পুস্তক রয়েছে। প্রকাশনার জগতে পাকিস্তান জমঈয়ত তার একাধিক আঞ্চলিক শাখা থেকে উর্দু ও আরবি ভাষায় পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সাময়িকী প্রকাশ করে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ:

  • মাসিক আহলে হাদীসঅমৃতসর
  • মাসিক আহলে হাদীসলাহোর
  • তরজুমানে আহলে হাদীস
  • আল ইতিসাম
  • আল রিবাত
  • সউতুল উম্মাহ
  • মুসলিম
  • তাওহীদ
  • সউতুল হক
  • ও সিরাতে মুস্তাকীম ইত্যাদি।

 জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস প্রতিষ্ঠা:

১৯৮৫ খৃষ্টাব্দে ছাত্র ও যুবকদের জন্য গঠন করা হয় জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস এবং জমঈয়তে তালাবায়ে আহলে হাদীস পাকিস্তান। এরপর এই পদ্ধতিতে ভারত উপমহাদেশের অন্যান্য দেশেও আহলে হাদীস ছাত্র ও যুবকদের জন্য আলাদা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১৯৯৩ খৃষ্টাব্দে অক্টোবরে পাকিস্তান জমঈয়তে আহলে হাদীসের জাতীয় নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে বেশ কয়েকটি সিটে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়। জমঈয়তের আমীর প্রফেসর সাজিদ মীর পাকিস্তানের পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন।

আহলে হাদীসদের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব:

ক) পাকিস্তান:

পাকিস্তানে আহলে হাদীসের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন:

১) শাইখ মুহাম্মদ দাউদ গজনবী (১৮৯৫-১৯৬৩খৃ:):

তিনি পাকিস্তান জমঈয়তের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সভাপতি। তিনি ফয়সালাবাদে জামেয়া সালাফিয়া প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আল্লামা মুহাম্মদ ইসমাইল এর সাথে শরীক হন। তিনি পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী আইন বাস্তবায়নে সম্মতি দিয়ে প্রশংসিত হন। কাদিয়ানী এবং হাদীস অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে তার অনেক ইলমী অবদান রয়েছে।

মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে তিনি এর প্রথম কেবিনেট সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম প্রণয়নে অংশ গ্রহণ করেন।

২) আল্লামা মুহাম্মদ ইসমাইল সালাফী ( মৃত্যু: ১৯৬৮খৃ:)

আল্লামা মুহাম্মদ ইসমাইল সালাফী পাকিস্তানে জামেয়া আহলে হাদীস প্রতিষ্ঠার অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি পাকিস্তানের মাটিতে দাওয়াহ ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রে প্রভাব সৃষ্টিকারী ভূমিকা রাখেন। গুজরানাওয়ালা আহলে হাদীস জামে মসজিদের খতীবের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান জামেয়া মুহাম্মাদিয়ার শিক্ষক বোর্ডের প্রধান ছিলেন। অনুরূপভাবে তিনি পাঞ্জাব জমঈয়তে আহলে হাদীসের প্রধান কার্যালয়ের তত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন এবং ১৯৪৬ সালের দিল্লী কনফারেন্সের মাধ্যমে তাকে জমঈয়তের ইলমী কমিটির সেক্রেটারি নির্বাচন করা হয়।

১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির পর তিনি পাকিস্তান জমঈয়তে আহলে হাদীসের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন এবং মৃত্যু অবধি (১৯৬৮ সাল) তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।

শাইখ মুহাম্মদ ইসমাইল সালাফী কাদিয়ানী ফিতনা প্রতিরোধ কল্পে গঠিত ‘খতমে নবুওয়ত আন্দোলন’ এর কার্যকরী পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন।

১৯২৪ সালে হিন্দুত্ববাদী ‘শুদ্ধি আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন যখন মুলকান এলাকায় মুসলিমদেরকে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরের কাজ শুরু করেছিল তখন তাদের প্রতিরোধে গঠিত হয়েছিল তাবলীগী প্রতিনিধি দল। আল্লামা ইসমাইল সালাফী রহ. এই দলের একজন একনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। সেই সাথে তিনি দাওয়াহএরশাদতাদরীসফতোয়া ইত্যাদিরও কাজও আঞ্জাম দেন।

অনুরূপভাবে ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির পর ভারত থেকে পাকিস্তানে হিজরতকারী পরিবার সমূহের পুনর্বাসন এবং তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে শাইখের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। সেই সাথে তিনি অনেক মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন।

এত কিছুর পরেও পাকিস্তানের রাজনীতিতে তার বিশাল ভূমিকা ছিল। রাজনৈতিকভাবে তিনি প্রভাবিত ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ দ্বারা। তিনি এবং মুহাম্মদ দাউদ গজনবী পাকিস্তানে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার দাবিতে পাকিস্তান সরকারের নিকট জমঈয়তের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন।

১৯৫২ সালে পাকিস্তানে ইসলামী সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে তিনি সদস্য নির্বাচিত হন।

১৩৮৭ হিজরী ২৩ জিলকদ মোতাবেক ১৯৬৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিমঙ্গলবার তিনি পরলোক গমন করেন।

তিনি বেশ কতিপয় গ্রন্থ রচনা করেন। তন্মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলবিখ্যাত হাদীস সংকলন মিশকাতুল মাসাবীহ গ্রন্থের উর্দু অনুবাদ ও ব্যাখ্যা।

৩) আল্লামা মুহাম্মদ বিন ফজলুদ্দীন গুন্দলবী (মৃত্যু: ১৯৮৫খৃ.):

শাইখ মুহাম্মদ ইসমাইল সালাফী এর পর বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও উসূলবীদ আল্লামা আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ বিন ফজলুদ্দীন গুন্দলবী জমঈয়তের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

৪) আল্লামা শাইখ এহসান এলাহি যহীর (মৃত্যু: ১৯৮৭খৃ:):

বিশিষ্ট বাগ্মী আল্লামা শাইখ এহসান এলাহি যহীর, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লিসান্স প্রাপ্ত। তিনি বিদয়াত পন্থীদের বিরুদ্ধে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন।

৫) প্রফেসর সাজিদ মীর:

জমঈয়তের বর্তমান সভাপতি প্রফেসর সাজিদ মীর যিনি ১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জমঈয়তের বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল শাইখ মিয়া মুহাম্মদ জামীল।

৬) আল্লামা আবু মুহাম্মদ বদীউদ্দীন শাহ রাশেদী সিন্ধী:

পাকিস্তানের আরও একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা আবু মুহাম্মদ বদীউদ্দীন শাহ রাশেদী সিন্ধী। বর্তমান যুগের অন্যতম বড় মুহাদ্দিস। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন সনদের অধিকারী। কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক তার বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে। তিনি দুই হারামে দারস দিয়েছেন। ভারত, পাকিস্তান সহ বিভিন্ন দেশ থেকে তার প্রচুর ছাত্র রয়েছে।

খ) ভারত:

ভারতে আহলে হাদীসের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন:

-শাইখ আব্দুল ওয়াহাব আরাবী। তিনি পাক-ভারত বিভাজনের পরে ভারতে জমঈয়তের নবগঠিত কমিটির প্রথম সভাপতি ছিলেন।

-শাইখ আব্দুল জলীল রহমানী (মৃত্যু: ১৯৮৬): তিনি ছিলেন জমঈয়ের সেক্রটারী জেনারেল। তিনি উর্দু ভাষায় কুরআনের তাফসীর রচনা করেন এবং তার তত্ত্বাবধানে আল মিসবাহ নামে প্রকাশিত হয় একটি উর্দু ম্যাগাজিন ।

– আব্দুল হাফীজ সালাফী। তিনি শায়খ আব্দুল ওয়াহাব আরাবীর পরে জমঈয়তের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। বর্তমানে তিনি বিহারে প্রতিষ্ঠিত জামেয়া আহমদিয়া সালাফিয়া এর পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন।

-শাইখ আব্দুল ওয়াহীদ বিন আব্দুল হক সালাফী (মৃত্যু: ১৯৮৯খৃ): তিনি শাইখ আব্দুল হাফীজ সালাফীর পর জমঈয়তের সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত হন। সেই সাথে তিনি জামেয়া সালাফিয়া বেনারস এর প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে মৃত্যু অবধি পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন।

শাইখ আব্দুল হামীদ বিন আব্দুল জব্বার রহমানী। লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি ইতোপূর্বে জমঈয়তের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এওয়াইকিং সেন্টার দিল্লী’র প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

-শাইখ মুখতার আহমদ নদভী। তিনি আদ দার আস সালাফিয়া-বোম্বাই এর পরিচালক। তিনি মারকাযী জমঈয়তে আহলে হাদীস-হিন্দ এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আর সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, শাইখ আব্দুল ওয়াহিদ খিলজী, লিসান্স: মদীনা ইসলামী বিশ্বিবদ্যালয়।

– শাইখ উবায়দুল্লাহ রহমানী মোবারকপুরী রহ.:

ভারতে আহলে হাদীসদের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম হলেনজামেয়া সালাফিয়া-বেনারস এর প্রধান প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাইখ উবায়দুল্লাহ রহমানী মোবারকপুরী রহ.। তিনি ‘মিরআতুল মাফাতীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ’ গ্রন্থের রচয়িতা।

– শাইখ আব্দুস সামাদ শরফ উদ্দীন ও ডক্টর মুক্তাদা হুসাইন আযহারী:

এ ক্ষেত্রে আল্লামা শাইখ আব্দুস সামাদ শরফ উদ্দীনের নাম উল্লেখযোগ্য। আরেক জন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব হলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ডক্টর মুক্তাদা হুসাইন আযহারী। তিনি জামেয়া সালাফিয়া বেনারস এর প্রভোস্টমাসিক সউতুল উম্মাহ ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক এবং ইলমী গবেষণা বিভাগের প্রধান। এ ছাড়াও বিরাট সংখ্যক বিদগ্ধ উলামায়ে কেরাম রয়েছেন যারা সুন্নাহ ও দাওয়াহর খেদমতে নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছেন।

কেরালা প্রদেশ:

 

কেরালা প্রদেশে জমঈয়তের অঙ্গ সংগঠন জমঈয়ত নাদওয়াতুল মুজাহিদীন’ এর চারটি শাখাকে সমগ্র ভারতে সর্বাধিক তৎপর সালাফী সংগঠন হিসেবে গণ্য হয়।

তাদের তত্বাবধানে প্রায় ২৮০টি মসজিদ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়৪০০টি মাদরাসা ও স্কুলকয়েকটি কলেজএতিমখানাহাসপাতাল এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। তাদের পরিচালনায় ৪টি পত্রিকা এবং কয়েকটি যুবনারী ও শিশুতোষ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। অনুরূপভাবে কেরালা জমঈয়তের একটি ডক্টরস ফোরাম রয়েছে যার নামএসোসিয়েশন অব মুসলিম ডক্টরসকেরালা (Association of Muslim doctors in Kerala)

ভারতের কেরালা প্রদেশে জমঈয়ত ৫টি সালাফী ইসলাহী বিভাগের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। যথা:

১) নাদওয়াতুল মুজাহিদীন: তাদের মৌলিক কাজ হল সর্ব সাধারণের নিকট ইসলাম প্রচারের কাজ করা। এটাই হল সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দু। এর অধিনে ৪৭৫টি শাখা রয়েছে।

২) লাজনাতুল বুহুসুল ইলমিয়া-কেরালা: এ বিভাগটি গবেষণা,ফতওয়া,দিক নির্দেশনা ও দাওয়াতি কার্যক্রম আঞ্জাম দিয়ে থাকে।

৩) ইত্তিহাদ শুব্বানুল মুজাহেদীন: এ বিভাগটি তরুণদের নিয়ে কার্যক্রম করে থাকে। তাদের ৪৭১টি শাখা রয়েছে।

৪) মুজাহিদ স্টুডেন্টস মুভমেন্ট: এ বিভাগটি বিভিন্ন স্তরের ছাত্রদের নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তাদের ৪২৭৭টি শাখা রয়েছে।

৫) মুজাহিদ গালর্স মুভমেন্ট: তাদের মোট ৫১২৭টি শাখা রয়েছে।

কাশ্মীর:

আল্লামা নাজির হুসাই মুহাদ্দিস দেহলবী এর ছাত্র শাইখ মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন শাহ এবং শাইখ মাওলানা আনোয়ার শাহ শুবিয়ানী (ইলমুল ফারায়েজ বা উত্তরাধিকার শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ)। এই দু জন পণ্ডিতের বিরাট প্রভাব রয়েছে কাশ্মীর আহলে হাদীস দাওয়াতের ক্ষেত্রে।

১৯২৩ সালে অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্স (যেটি পরবর্তীতে নাম করণ করা হয় মারকাযী জমঈয়তে আহলে হাদীস হিন্দ নামে) মাওলানা আব্দুল কাবীর এবং সাইয়েদ শামসুদ্দীনকে কাশ্মীরে ভ্রাম্যমাণ মুবাল্লিগ হিসেবে প্রেরণ করে। তাদের প্রচেষ্টায় কাশ্মীরের মাটিতে আহলে হাদীস কনফারেন্স,কাশ্মীর নামে আহলে হাদীস আন্দোলনের কার্যক্রম সূচিত হয়। এটি ১৯৪৫ সালে বাযমে তাওহীদ বা তাওহীদের দাওয়াত নামে পরিচিতি লাভ করে।

১৯৪৬ সালে জমঈয়তের পূর্ব নাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম মারকাযী জমঈয়তে আহলে হাদীস জুম্মু ও কাশ্মীর নির্ধারণের পাশাপাশি জমঈয়েত সংবিধান প্রণয়ন করা হয়।

জঈয়তের কার্যক্রমকে সুশৃঙ্খলভাবে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে জুম্মু-কাশ্মীরে পাঁচ শতাধিক শাখা অফিস খোলা হয়। এই সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত জনশক্তি পাঁচ লক্ষাধিক। এছাড়াও শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ,ফতোয়া,আওকাফ,মসজিদ,গবেষণা,দাওয়াহ,প্রচার ইত্যাদি প্রত্যেকটি কাজের জন্য জমঈয়তের আলাদা সাংগঠনিক বিভাগ রয়েছে।

সংগঠনের তত্ত্বাবধানে শ্রীনগরে সালাফী আকীদা নির্ভর প্রথম আরবি ও ইসলামী কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তৎসঙ্গে বেশ কয়েকটি মাদরাসা ও ইসলামী ইন্সটিটিউটও প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়াও প্রতিষ্ঠা করা হয় পাঁচ শতাধিক মসজিদ।

অনুরূপভাবে সংগঠনের উদ্যোগে যোগ্য ও দক্ষ দায়ী তৈরির উদ্দেশ্য বিভিন্ন সময় দায়ী প্রশিক্ষণ কোর্স এর আয়োজন করা হয় এবং কাশ্মীরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাওয়াতি কাজের উদ্দেশ্যে নিয়মিতভাবে প্রেরণ করা হয় দাওয়াতি কাফেলা ।

কাশ্মীর জমঈয়তের উদ্যোগে ১৯৫৭ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ২৮টি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানী শ্রীনগরে একটি পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং পরবর্তীতে সংগঠনের সকল শাখা অফিসের তত্ত্বাবধানে একটি করে পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকাশিত হয় মুসলিম নামে একটি ম্যাগাজিন ।

এ সব কিছু আয়োজনের উদ্দেশ্য হল,ইসলামের দুশমনদের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি সর্ব সাধারণের মধ্যে সালাফে সালেহীনের চেতনা ও আদর্শকে বদ্ধমূল করা। সেই সাথে ইলম ও আমলের সমন্বয় সাধন করে এমন একদল যোগ্যতা সম্পন্ন আলেম তৈরি করা যারা দীনের গভীর জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি আধুনিক সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন থেকে সমাজের চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে।

শাহ ইসমাইল শহীদ দেহলবী রহ. এর নেতৃত্বে পরিচালিত জিহাদী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবং আজাদ কাশ্মীর বিজেতা শাইখ ফজলে এলাহি ওয়াযিরাবাদী এর আদর্শিক প্রেরণায় উজ্জীবিত হয় গঠন করা হয় তাহরীকে মুজাহেদীন জুম্মু ও কাশ্মীর। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেন শাইখ আব্দুল গনী। তিনি অধিকৃত কাশ্মীরের কারাগারগুলোতে দু বছরের বেশি সময় বন্দি অবস্থায় কাটান।

তারপর তেরোটি জিহাদী সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় কাশ্মীর জিহাদ বোর্ড। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক তিন সেশনে এই বোর্ডের নেতৃত্ব প্রদান করেন শাইখ তানবীরুল ইসলাম। তারপর নেতৃত্বে আসেন শাইখ মুহাম্মদ এলাহি।

এই জিহাদি আন্দোলনের পক্ষ থেকে আরবি ও উর্দু ভাষায় দুটি ম্যাগাজিন নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এগুলো কাশ্মীরে সার্বিক জিহাদের অবস্থা পর্যালোচনা এবং বিশেষ করে তাহরীকে মুজাহেদীন আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেব প্রকাশিত হতে থাকে।

এ ছাড়াও তাদের উদ্যোগে শিক্ষা,জনকল্যাণ ও দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কয়েকটি প্রকল্প পরিচালনা করা হয়। এ প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে মুজাহিদহিজরতকারী পরিবার ও জনসাধারণ সবার জন্য বিভিন্ন সেবা প্রদান করা হয়।

কাশ্মীরে জমঈয়তের বরেণ্য বক্তিবর্গ:

অধিকৃত কাশ্মীরে জমঈয়তের উল্লেখযোগ্য ও বরেণ্য ব্যক্তিত্ব হলেন, আলহাজ্ব মুহাম্মদ শাহদাদ। তিনি ছিলেন কাশ্মীর জমঈয়তের প্রথম সভাপতি। তারপর সংগঠনের নেতৃত্বে আসেনে মাওলানা গোলাম নবী মোবারক। তারপর সংগঠনের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল গনী শুবিয়ানী। তারপর শাইখ আব্দুল্লাহ তারী। তিনি কাশ্মীর জমঈয়তে আহলে হাদীস এর নেতৃত্ব প্রদানের পাশাপাশি কাশ্মীর লিবারেশন মুভমেন্ট এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। যে কারণে ভারত সরকার তাকে দু বছরের অধিক সময় কারাবন্দী রাখে। শাইখ আব্দুল্লাহর অবর্তমানে জমঈয়ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন শাইখ মুহাম্মদ রামাযান সূফী এবং তারপর সাইয়েদ মুহাম্মদ মকবুল কিলানী।

বাংলাদেশ:

ক) শাইখ নেয়মাতুল্লাহ বারদাওয়ানী।

তাঁর নেতৃত্বে ১৯১৪ সালে আসামে জমঈয়তে আহলে হাদীস প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বাংলা ভাষায় কুরআনের অনুবাদক শাইখ আব্বাস আলী। তাদের সময়কালে জমঈয়তে আহলে হাদীস কুরআন-সুন্নাহর প্রচার-প্রসার ও শিরক-বিদয়াত বিরোধী সংগ্রামে যথেষ্ট অবদান রাখে। এ সময় জমঈয়তের উদ্যোগে কয়েকটি সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়।

খ) আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল কোরায়শী রহ.।

জমঈয়তের উদ্যোগে ১৯৪৬ সনে অনুষ্ঠিত কনফারেন্স এর মাধ্যমে সংগঠনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এরপর সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেয়া হয়‘নিখিল বঙ্গ-আসাম জমঈয়তে আহলে হাদীস।’ সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হনমাওলা বখশ নাদভী।

এরপর একাধিক কনফারেন্স অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংগঠনের সংবিধানসিলেবাস এবং বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় এবং ইলাকা ও জেলা ভিত্তিক শাখা গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয় মাসিক তর্জমানুল হাদীস।

আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী কোরায়শীর (রহ.) এর নেতৃত্বে পাকিস্তানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একাধিক রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতি এবং পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান রচনা করেন। এ উপলক্ষে তাঁর নেতৃত্বে ইসলামী দল সমূহের সমন্বয়ে মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

গ) ডক্টর মুহাম্মদ আব্দুল বারী:

আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী রহ. এর ইন্তেকালের পর প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ আব্দুল বারী রহ. ১৯৬০ সালে জমঈয়তের সভাপতি নির্বাচিত হন আর সেক্রেটারি হিসেবে নির্বাচিত হন জনাব আব্দুর রহমান। তিনি সেই সাথে জমঈয়তের মুখপাত্র সাপ্তাহিক আরাফাত এর সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন।

১৯৭২ সালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হওয়ার পর তার সময়কালে জমঈয়ত অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়। দেশ ভাগের পর সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেয়া হয় ‘বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস।’

এ সময় সংগঠনের ৩৬৯টি আঞ্চলিক শাখা৫১০০টি উপশাখা গঠিত হয়। অনুষ্ঠিত হয় সাতটি কেন্দ্রীয় কনফারেন্স।

নেপাল:

ক) শাইখ আব্দুর রঊফ রহমানী ঝাণ্ডাগরী:

তিনি ছিলেন নেপাল জমঈয়তে আহলে হাদীসের সভাপতি ও জামেয়া সেরাজুল ঊলূম আস সালাফিয়ার সেক্রেটারি। তিনি মক্কায় রাবেতা আলম আল ইসলামীর ফাউন্ডেশন বোর্ডের সদস্যও ছিলেন। তাঁর রচিত ৪৫ এর অধিক গ্রন্থ রয়েছে। এ গ্রন্থগুলো হাদীস ও ইলমে হাদীস এবং ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে রচিত। হাদীস এবং মুহাদ্দিসগণের বিরুদ্ধাচারণ কারীদের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাদির মধ্যে রয়েছে,একত্ববাদের প্রমাণাদি,খেলাফতে রাশেদা, সুদ ও জুয়া হারাম, ঈমান ও আমল ইত্যাদি।

খ) শাইখ আব্দুল্লাহ আব্দুত তাওয়াব আল মাদানী:

তিনি নেপাল মাদরাসা খদীজাতুল কুবরা এর প্রতিষ্ঠাতা ও মাসিক নূরে তাওহীদ ম্যাগাজিন এর সম্পাদক। তিনি প্রথমত: জামেয়া সালাফিয়া বেনারস এবং তারপরে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন।

তিনি বর্তমানে সউদী ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত নেপালি মুবাল্লিগদের সুপারভাইজার এবং নেপাল জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস এর দায়িত্বশীল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ভারত উপমহাদেশে আরও কতিপয় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব:

ভারত উপমহাদেশে দাওয়াহ,তাদরীস,লেখনী ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আহলে হাদীসগণের বিরাট অবদান রয়েছে। আকীদাইবাদতরাজনীতিঅর্থনীতি ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আহলে হাদীস মনিষীগণ রেখেছেন অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর। আরও সে সকল মনিষীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

  • শাইখ মুহাম্মদ হুসাইন বাট্টালবী 
  • শাইখ মুহাম্মদ ইবরাহীম শিয়ালকোটী
  • শাইখ আব্দুল্লাহ রোপড়ী
  • তার ভাই শাইখ হাফেজ মুহাম্মদ হুসাইন
  • শাইখ আতা উল্লাহ হানীফ
  • শাইখ মুহাম্মদ সিদ্দীক সারজুদী
  • শাইখ আব্দুস সাত্তার দেহলবী
  • শাইখ জামীলুর রহমান আফগানী
  • শাইখ আব্দুল জাব্বার কান্দলোবী
  • শাইখ মুহাম্মদ আলী লক্ষৌবী মাদানী,
  • শাইখ আব্দুল হক মুলতানী
  • শাইখ মুহাম্মদ জুনাগড়ী
  • শাইখ হাফেজ আব্দুল হাই কিলানী
  • আব্দুল আযীয মাইমানী
  • শাইখ আব্দুস সালাম বাসনুবী
  • শাইখ আবুল কাসেম বেনারসী
  • শাইখ মুহাম্মদ সূরতী
  • শাইখ আব্দুল জলীল সামরূদী
  • শাইখ মুহাম্মদ আশরাফ সিন্ধী
  • শাইখ আব্দুল কাদের কাসূরী
  • শাইখ মুহাম্মদ আব্দুহ আল ফাল্লাহ
  • মাওলানা মুইনুদ্দীন লক্ষৌবী
  • হাফেজ আব্দুর রহমান মাদানী
  • এবং হাফেজ মুহাম্মদ সাঈদ প্রমূখ।

আহলে হাদীসগণের আকীদা এবং মূলনীতি:

 

১) তাওহীদ:

আহলে হাদীসগণ বিশ্বাস করে যেতাওহীদ হল দ্বীনের মূল ভিত্তি। তারা তাদের কার্যক্রম শুরু করে খালেস তাওহীদের মাধ্যমে। এই তাওহীদকে মানুষের হৃদয়পটে প্রোথিত করার জন্য তারা চেষ্টা করে। তাওহীদের তিন প্রকারের মধ্যে বিশেষ করে তাওহীদে উলূহিয়ার ব্যাপারে আহলে হাদীসগণ সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব প্রদান করে। কেননাএ প্রকার তাওহীদের ব্যাপারেই অধিকাংশ মানুষ ভুলে নিমজ্জিত। যদিও তারা তাওহীদে রুবুবিয়ায় বিশ্বাস করে যার দাবী হলশাসন ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর।

আহলে হাদীসগণ কেবল রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাস করাকেই যথেষ্ট মনে করে না বরং বিশ্বাস করে, মানুষের ব্যক্তি জীবন, আচার-আচরণ, লেনদেন, চিন্তা-চেতনা থেকে শুরু করে আইন ও সংবিধান প্রণয়ন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা তথা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র হুকুম দাতা।

২) ইত্তিবা:

আহলে হাদীসগণ সালাফে-সালেহীনের বুঝ ও ব্যাখ্যার আলোকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত হাদীস অনুসরণের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করে। যার কারণে, তারা অন্ধ তাকলীদ তথা দলীল জিজ্ঞেস করা ছাড়া বিশেষ মাযহাব গ্রহণ করাকে সঠিক মনে করে না। বরং তারা যে ব্যক্তির মধ্যে ইজতিহাদের শর্তাবলী বিদ্যমান রয়েছে তার জন্য ইজতিহাদের দরজা উন্মুক্ত করার প্রতি আহবান করে।

সাধারণ মানুষ সেভাবেই আমল করবে যেভাবে যোগ্য আলেমগণ সালাফে-সালেহীনের বুঝ ও ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক ফতোয়া প্রদান করবেন।

আহলে হাদীসগণ আলেমদেরকে বিশেষ করে প্রচলিত মাযহাব সমূহের মহামতি ইমামগণকে বিশেষভাবে সম্মান ও শ্রদ্ধা করার আহবান জানায়।

৩) তাকদীমুন নকলি আলাল আকল (যুক্তির উপর দলীলকে প্রাধান্য দেয়া):

আহলে হাদীসদের মূলনীতির অন্তর্ভূক্ত হল, রায়, কিয়াস বা যুক্তির উপর দলীলকে প্রাধান্য দেয়া । অর্থাৎ যখনই কোন রেওয়ায়াত বা দলীল পাওয়া যাবে তখন সেখানে ব্যক্তি-বিশেষের রায় বা মতামত ও যুক্তি উপর সেই দলীলকে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। এটা আহলে হাদীসদের একটি অন্যতম নীতি। কারণতারা মনে করে সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির সাথে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত শরীয়তের দলীল সাংঘর্ষিক হতে পারে না। সেহেতু শুধু যুক্তি ও বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা শরীয়তের কোন বিষয়ের বিরুদ্ধাচরণ করা কিংবা শরীয়তের উপর যুক্তি ও বিচার-বুদ্ধিকে অগ্রাধিকার প্রদান করা বৈধ নয়।

৪) তাযকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি:

মানুষের মন-মননচিন্তা ও চেতনাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা আহলে হাদীসগণের অন্যতম রীতি। তবে তারা বিভিন্ন সূফী তরীকায় আত্মশুদ্ধির বিরোধিতা করে।

৫) বিদআত থেকে সাবধান:

আহলে হাদীসগণের আরেকটি রীতি হল,বিদআত থেকে মানুষকে সতর্ক করা। কারণতারা মনে করে বিদআত করা মানে স্বয়ং আল্লাহর ত্রুটি অনুসন্ধান করে মানবিক বিবেক-বুদ্ধির আলোকে শরীয়তে সংযোজন করা। যার কারণেতারা সুন্নতকে দৃঢ়ভাবে ধারণ ও সকল প্রকার বিদআত বর্জন করার প্রতি আহবান জানায়।

৬) যঈফ ও মওযূ হাদীস থেকে সতর্ক করা:

যঈফ (দূর্বল) ও মওযূ (বানোয়াট বা জাল) হাদীস থেকে সতর্ক করা আহলে হাদীসগণের একটি অন্যতম রীতি। কারণমুসলিম উম্মাহর উপর এ জাতীয় হাদীসের কুফল অত্যন্ত ভয়াবহ। এই জন্য আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে কোন হাদীস বলা হলে সে ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে তা যদি আকীদা ও আহকামের ব্যাপারে হয়।

৭) জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ:

আহলে হাদীসগণ বিশ্বাস করেআল্লাহর পথে জিহাদ করা অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল। পৃথিবীর বুকে আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করা ও বিশৃঙ্খলা প্রতিহত করতে এই জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّـهِ

তাদের সাথে লড়াই অব্যহত রাখো যত দিন না ফিতনা নির্মূল হয় ও দ্বীন পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়। (সূরা আনফান: ৩৯)

৮) রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করা:

আহলে হাদীসগণ শরীয়ত সম্মত পন্থায় ব্যক্তিগত,সামাজিক, রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক তথা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তকে মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে।

আহলে হাদীসগণ বিশ্বাস করে,বিশ্ব চরাচরের একচ্ছত্র অধিপতি মহান আল্লাহ তায়ালার খালেস তাওহীদ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত ও আদর্শ মোতাবেক আমল করার মাধ্যমেই পৃথিবীতে বিজয় ও ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব। কারণ, এ দুটি জিনিস যেমন আমল কবুল হওয়ার শর্ত তদ্রূপ পৃথিবীতে শাসন কর্তৃত্ববিজয় ও ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠারও শর্ত। আল্লাহ তায়ালা এ দুটি শর্ত সাপেক্ষেই শাসন কর্তৃত্ব ও খিলাফতের দায়িত্ব প্রদানের ওয়াদা করেছেন। তিনি বলেন,

وَعَدَ اللَّـهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَىٰ لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّن بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا ۚ يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا ۚ وَمَن كَفَرَ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ

তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে,তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসন কৃর্তৃত্ব দান করবেন। যেমন তিনি শাসন কর্তৃত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্মকে, যা তিনি তাদের জন্যে পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার এবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারাই অবাধ্য।” (সূরা নূর: ৫৫)

এ কারণে আহলে হাদীসগণ শরীয়ত সম্মত সম্ভাব্য সকল উপায়-উপকরণ ব্যবহার করে এ লক্ষ্যে দাওয়াতি কাজ করছে,যেন তাওহীদকে শিরক-বিদআতের পঙ্কিলতাআকীদা ও আচরণগত ভ্রান্তির কলুষ থেকে মুক্ত করা যায়। সেই সাথে প্রচলিত বানোয়াট হাদীসগুলোকে সহীহ হাদীস থেকে পরিচ্ছন্ন কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী সুস্থ ও বিশুদ্ধ আকীদা সম্পন্ন একটি জাতি গঠন করা যায়।

৯) বাতিল ফিরকা ও দল-উপদলের প্রতিবাদ:

আহলে হাদীসগণ বৈধ সম্ভাব্য সকল উপায়ে ইসলামের নামে গোমরাহ বিভিন্ন ফিরকা ও দল-উপদলের প্রতিবাদ করে থাকেন। যেমন শিয়াকাদিয়ানীব্রেলভীবাহাঈ ইত্যাদি।

অনুরূপভাবে তারা ইসলাম বিধ্বংসী বিভিন্ন সমকালীন মতবাদেরও প্রতিবাদ করেন। যেমন ধর্ম নিরপেক্ষতা, পুঁজিবাদ, কম্যুনিজম, সোশ্যালিজম ইত্যাদি।

আহলে হাদীসগণের আকীদা ও আদর্শগত ভিত্তি:

  • আহলে হাদীসগণ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আদর্শের আলোকে পূর্ববর্তী মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের রীতি অনুসারে কুরআন-সুন্নাহ থেকে আকীদা ও আহকাম গ্রহণ করে থাকে।
  • তারা সাধারণভাবে পূর্ববর্তী মনিষীদের বিশেষত: ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, ইমাম ইবনুল কাইয়েম জাওযিয়া, ইমাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব প্রমুখের গ্রন্থাদি অধ্যয়নের প্রতি জোর দিয়ে থাকেন।
  • অনুরূপভাবে আধুনিক যুগের সালাফী দাওয়াতের পথিকৃৎ সউদী আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি শাইখ আল্লামা আব্দুল আজীজ বিন বায রহ.যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. প্রমুখের গ্রন্থাদি প্রচার ও প্রসার করে থাকে।

আহলে হাদীসদের সম্প্রসারণ এবং অবস্থান: 

আহলে হাদীস জামায়াত ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, কাশ্মীর, শ্রীলংকা এবং ফিজি দ্বীপপুঞ্জ ইত্যাদি এলাকায় সম্প্রসারিত। ব্রিটেনেও তাদের শাখা রয়েছে। এ সকল এলাকায় তারা জমঈয়তে আহলে হাদীস নামে পরিচিত। উক্ত দেশগুলোর প্রত্যেকটিতেই জমঈয়তের কেন্দ্র রয়েছে এবং প্রদেশ ও জেলা ভিত্তিক তাদের শাখা রয়েছে। প্রত্যেক দেশের নেতৃত্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু এটা কেবল সাংগঠনিক প্রক্রিয়া মাত্র। প্রকৃতপক্ষে সালাফী মূলনীতি ও আদর্শে তারা এক ও অভিন্ন।

জমঈয়তে আহলে হাদীস ভারত উপমহাদেশের বাইরের একই মূলনীতি ও আদর্শে বিশ্বাসী অন্যান্য সংঘ ও সংগঠনের সাথেও সম্পর্ক রাখে। যেমন, জামায়াতুদ দাওয়াহ ইলাল কুরআনি ওয়াস সুন্নাহ-আফগানিস্তান, জমঈয়তে মুহাম্মাদিয়া ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া এবং জামায়াত আনসারুস সুন্নাহ- মিসরসুদান ও ইরিত্রিয়া, জমঈয়তে এহইয়াউত তুরাস আল ইসলামী-কুয়েত এবং জমঈয়তুল বির-দুবাই ইত্যাদি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত সালাফী দাওয়াতি সংগঠন।

অনুরূপভাবে জমঈয়তে আহলে হাদীস ওয়ার্ল্ড এসেম্বলী অফ মুসলিম ইয়ুথ (WAMY),রাবেতা আলম আল ইসলামী, ওয়ার্ল্ড ইসলামিক কাউন্সিল অব লন্ডন, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক কাউন্সিল ফর দাওয়াহ এন্ড রিলিফ-কায়রো এর সদস্য।

(সমাপ্ত)

 

>>>>>কৃতজ্ঞতাঃ- Salafibd<<<<<