বিদআতের ভয়াবহতা এবং আমাদের সমাজের চিত্র

বিদআতের ভয়াবহতা এবং আমাদের সমাজের চিত্র
সংকলনে: আবুল হোসেন
সম্পাদনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী, দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদী আরব।

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

“যে ব্যক্তি এমন আ‘মাল করল যে ব্যাপারে আমাদের আমাদের নির্দেশ নেই তা পরিত্যাজ্য।” (সহীহ মুসলিম)

ভূমিকাঃ সুপ্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ, পৃথিবীর দ্বীতিয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ নানা ধরণের সমস্যায় জর্জরিত। তম্মধ্যে ধর্মীয় ক্ষেত্রে অন্যতম বড় সমস্যা হল বিদআত সমস্যা। বর্তমানে আমরা অজ্ঞতা বা বিভিন্ন কারণে ধর্মের নামে নানা ধরণের বিদআতী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছি। যার কারণে আমরা যেন ধীরে ধীরে রাসূল (ﷺ) এর সুন্নাহ থেকে দূরে সরে পড়ছি। তাই মুসলিম ভাই-বোনদেরকে এ সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্যে আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। এতে আমি বিদআতের সংজ্ঞা, বিভক্তি, কি ভাবে বিদআত শুরু হয় এবং বিদআত করার কি ভয়াবহ পরিণতি ইত্যাদি যথাসম্ভব উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ সহকারে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথের উপর অটুট থেকে জীবন পরিচালনা করার তওফীক দান করুন। বিদআতের ভয়াবহতা এবং

বিদআতের সংজ্ঞাঃ বিদআতের আবিধানিক অর্থ হল, নব আবিস্কৃত ও নব উদ্ভাবন। পারিভাষিক অর্থে দ্বীনের মধ্যে নতুন কোন কিছু সংযোজন করার নাম বিদআত।

ইমাম নওবী (রহঃ) বিদআত শব্দের অর্থ লিখেছেন, “(ছোওয়াবের আশায়) এমন সব কাজ করা বিদআত যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই।”

আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) লিখেছেন, “শরীয়তের পরিভাষায় বিদআত হল, রাসূল (ﷺ) এর যুগে ছিল না এমন নীতি ও পথ কে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে প্রবর্র্তন করা।”

অন্য ভাষায় বলতে গেলে, প্রত্যেক সে কাজকে বিদআত বলা হয় যা সোয়াব ও পূণ্যের নিয়তে করা হয় কিন্তু শরীয়তে তার কোন ভিত্তি বা প্রমাণ পাওয়া যায়না। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে করেননি এবং কাউকে তা করার অনুমতি ও প্রদান করেননি। এরূপ আ‘মাল আল্লাহর কাছে গ্রহণ যোগ্য হয় না। (বুখারী ও মুসলিম)

দ্বীনের সবচেয়ে বেশী ক্ষতিকারক বিষয় হলো বিদআতঃ যেহেতু বিদআতকার্য পূণ্য ও ছাওয়াবের কাজ মনে করা হয় সেহেতু বিদআতী ব্যক্তি তা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারেনা। অথচ অন্যান্য পাপসমূহে বোধশক্তি থাকে। তাই আশা করা যায় যে, পাপী কোন না কোন দিন আপন পাপে লজ্জিত হয়ে নিশ্চয় তওবা-ইস্তেগফার করবে। এ জন্যই ছুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, “শয়তান পাপের পরিবর্তে বিদআতকেই খুবই ভালোবাসে।”

বিদআতী কাজ যেহেতু সাওয়াব অর্জনের উদ্দেশ্যে করা হয় সেহেতু বিদআত থেকে তাওবা করার চিন্তা ও করা হয় না। তাই বিদআতীর মৌলিক আকীদা সংশোধন হওয়ার তো প্রশ্নই আসেনা।

শরীয়তের দৃষ্টিতে দুটি পাপ এমন আছে যেগুলো না ছাড়া পর্যন্ত কোন আ‘মাল কবুল হয়না । পাপ দুটি হল, শিরক ও বিদআত।

রাসূল (ﷺ) বলেন, “আল্লাহ তাআলা বান্দার পাপ মাফ করতে থাকেন যতক্ষণ না আল্লাহ তায়ালার মাঝে পর্দা হয়। ছাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, পর্দা কী? তিনি বললেন, “পর্দা হলো, মানুষ শিরক অবস্থায় মৃত্যু বরণ করা।” (মুসনাদ আহমাদ)

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “আল্লাহ তায়ালা বিদআতীর তওবা গ্রহণ করবেন না যতক্ষণ না বিদআত ছেড়ে দেয়।” (তাবারানী)

কিয়ামতের দিন যখন রাসূল আকরাম (ﷺ) হাউযে কাওসারে আসবেন যাদেরকে রাসূল (ﷺ) তার উম্মত মনে করবেন কিন্তু ফেরেশ্তাগণ বলবেন, এরা হলো সে সকল ব্যক্তি যারা আপনার পরে বিদআত শরু করে দিয়েছিল। রাসূল (ﷺ) তখন বলবেন, “সুহকান, সুহকান” “দূর হয়ে যাও, দূর হয়ে যাও সে সকল লোক যারা আমার পরে দ্বীনকে পরিবর্তন করেছ।” (বুখারী ও মুসলিম)

কিয়ামতের দিন কিছু লোক এমন হবে যারা আ‘মাল করে ক্লান্ত হয়ে গেছে কিন্তু জলন্ত আগুনে তাদেরকে নিক্ষেপ করা হবে। (সূরা গাশিয়া ৩-৪)

বিদআতের বিভক্তিঃ

আমাদের সমাজের এক বড় শ্রেণীর লোকের অধিকাংশ আকীদা ও আমলের ভিত্তি হলো যঈফ (দূর্বল) ও মওযূ (জাল) হাদীস সমূহের উপর। তাই তারা তাদের সুন্নত বিরোধী ও বিদআত কার্য সমূহকে দ্বীনের সনদ দেয়ার উদ্দেশ্যে বিদআতে হাসানাও সাইয়্যেআ দুভাগে বিভক্ত করেছে। আর কিতাব-সুন্নাহের শিক্ষা থেকে অজ্ঞ জনসাধারণকে এটি বোঝানো হচ্ছে যে, বিদআতে সাইয়্যেআ হল, বাস্তবে পাপের কাজ কিন্তু বিদআতে হাসানা তো ছোয়াবের কাজ। অথচ রাসূল (ﷺ) বলেন, “কুল্লু বিদআতিন যালালাহ, কুল্লু যালালাতিন ফিন নার” অর্থাৎ সমস্ত বিদআত পথ ভ্রষ্টতা ও গোমরাহী এবং সমস্ত গোমরাহীর পরিণাম হচ্ছে জাহান্নাম। (মুসলিম)

বাস্তব কথা হল, বেদআতে হাসানার চোরা দরজা দিয়ে দ্বীনের মধ্যে অগণিত বিদআতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এবং বিভিন্ন মাসনূন ইবাদাতের স্থানে গায়রে মাসনূন ও মনগড়া ইবাদত জায়গা দখল করে সম্পূর্ণ একটি নতুন বিদআতী ধর্মের ভিত্তি রাখা হয়েছে। পীর-মুরিদীর নামে বেলায়েত, খেলাফত, তরীকত, সুলুক, বাইয়াত, নিসবত, ইজাযত, তাওয়াজ্জুহ, এনায়েত, ফরয, করম, জালাল, আস্তানা, দরগাহ, খানকাহ, ইত্যাদি পরিভাষা গড়া হয়েছে। আর মুরাকাবা, মুজাহাদা, রিয়াযত, চিল্লাকোশী, কাশফুল কুবূর, আলোক সজ্জা, সবুচা, চোমুক, নযর, মানত, কুন্ডা, ঝান্ডা, শ্যামা (গান), রকস (নৃত্য), হাল, ওয়াজদ, ইমামে যামেন, দোয়া ফায়েয, কাওয়ালী, পুঁথি, সুন্দলমালী, এবং কফিয়ত ইত্যাদি হিন্দু নিয়মে পুজা পাঠের নিয়ম-নীতি আবিস্কার করা হয়েছে।

মাযার সমূহে সজ্জাদনশীল, গদিনশীল, মাখদূম, জারুবকাশ, দরবেশ এবং মাস্তনরা এ স্বগড়িত ধর্মের রক্ষণা-বেক্ষণকারী এবং ঝান্ডা ধারী হয়ে আছে।

ফাতেহা শরীফ, কুল শরীফ, দশম শরীফ, চল্লিশা শরীফ, গেয়রবী শরীফ, নিয়ায শরীফ, করামত বর্ণনা, স্বগড়িত যিকির আযকার ও ওযীফা সমূহের মত গায়েরে মাসনূন ও বেদআতী কার্যাবলীকে ইবাদতের স্থান দেয়া হয়েছে।

আর কোথাও এসকল ইবাদতের কিঞ্চিত ধারণা থাকলে বিদআতের দ্বারা সেগুলোর আসল রূপ বিকৃত করা হয়েছে। উদাহরণ সরূপ, ইবাদতের একটি দিক যিকিরকে নিন। দেখুন, তাতে কী কী ভাবে কত ধরণের মনগড়া কথা যোগ করা হয়েছে। যেমনঃ

১) ফরয নামাযের পর উচ্চস্বরে সম্মিলিতভাবে যিকির করা।

২) যিকির করার সময় আল্লাহর নাম মোবারকে কমবেশ করা।

৩) দেড় লক্ষবার আয়াতে কারীমার যিকিরের জন্য মাহফিল অনুষ্ঠান করা।

৪) মোহাররমের প্রথম রাত্রিকে যিকিরের জন্য নির্দিষ্ট করা।

৫) সফর মাসকে অশুভ মনে করা।

৬) ২৭ রজবকে শবে মেরাজ মনে করে যিকিরের ব্যাবস্থা করা।

৭) ১৫ শাবান যিকিরের মাহফিল অনুষ্ঠান করা।

৮) সায়্যেদ আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) নামে ওযীফা পড়া।

৯) সায়্যেদ আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) নামে নেসবতকৃত সারা সপ্তাহে ওযীফা পড়া।

১০) দোয়া গান্জুল আরশ, দোয়া জামিলা, দোয়া সুরয়ানী, দোয়া আক্কাশাহ, দোয়া হিযবুল বাহার, দোয়া আমন, দোয়ায়ে হাবীব, আহাদ নামা, দরূদে তাজ, দুরূদে শাহী, দুরূদে তুনাজ্জিনা, দুরুদে আকবর, হফত্ হায়কল শরীফ, চেহেল কাফ, কাদহে মুআয্যাম, শশ কুফল, ইত্যাদি ওযীফা সমূহ গুরুত্বের সহিত পড়া। এ সব ওযীফা আমাদের দেশে বাস, ট্রেন, গাড়ী ও সাধারণ দোকান গুলিতে খুবই স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায়। যা সাদা-সিধে অজ্ঞ মুসলিম ভায়েরা ক্রয় করে থাকেন। প্রয়োজন বশত দুঃখ-মুসিবতের সময় কাজে লাগিয়ে থাকে।

বিদআত কিভাবে চালু হয়?

বিদআত উদ্ভত ও চালু হওয়ার মূলে চারটি কার্যকরণ লক্ষ্য করা যায়ঃ

১) বিদআতী তা নিজের থেকে উদ্ভাবিত করে সমাজে চালিয়ে দেয়। পরে তা সাধারণভাবে সমাজে প্রচলিত হয়ে পড়ে।

২) কোন আলেম ব্যক্তি হয়ত শরীয়তের বিরোধী একটা কাজ করেছেন, তা শরীয়তের বিরোধী জানা সত্বেও কিন্তু তা দেখে জাহিল লোকেরা মনে করতে শুরু করে যে, এ কাজ শরীয়ত সম্মত না হয়ে যায় না। এভাবে এক ব্যক্তির কারণে গোটা সমাজেই বেদআতের প্রচলন হয়ে পড়ে।

৩) জাহিল লোকেরা শরীয়ত বিরোধী কাজ করতে শুরু করে। তখন সমাজের আলেমগণ সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরব হয়ে থাকেন। তার প্রতিবাদও করেন না। সে কাজ করতে নিষেধও করে করেন না। কখনো বলেন না যে, এ কাজ শরীয়তের বিরোধী, তোমরা এ কাজ কিছুতে করতে পারবে না। এরূপ অবস্থায় আলেমদের দায়িত্ব, সুযোগ ও ক্ষমতা থাকা সত্বেও বিদআত বা শরীয়ত বিরোধী কাজের প্রতিবাদ কিংবা বিরুদ্ধতা না করার ফলে সাধারণ লোকদের মনে ধারণা জন্মে যে, এ কাজ নিশ্চয় নাজায়েয হবে না বা বিদআত হবে না। বিদআত হলে কি আলেম সাহেবেরা প্রতিবাদ করতেন না? অথবা উমুক সভায় এ কাজটি হয়েছে, এ কথাটি বলা হয়েছে, সেখানে উমুক উমুক বড় আলেম উপস্থিতও ছিলেন তাঁরা যখন এর প্রতিবাদ করেননি তখন বুঝতে হবে যে, এ কাজ বা কথা শরীয়ত সম্মত হবেই। না হলে তো তাঁরা প্রতিবাদ করতেনই। এভাবে সম্পূর্ণ বিদআত বা জায়েয কাজ শরীয়ত সম্মত কাজ রূপে পরিচিত ও প্রচলিত হয়ে পড়ে।

৪) কোন কাজ হয়ত মূলতই ভালো, শরীয়ত সম্মত কিংবা সুন্নত অনুরূপ। কিন্তু বহুকাল পর্যন্ত তা সমাজের লোকদের সামনে বলা হয়নি, প্রচার করা হয়নি। তখন সে সম্পর্কে জন-সাধারণের ধারণা হয় যে, এ কাজ নিশ্চয় ভল নয়। ভাল হলে আলিম সাহেবেরা কি এতদিন তা বলতেন না? এভাবে একটি শরীয়ত সম্মত কাজকে শেষ পর্যন্ত শরীয়ত বিরোধী বলে লোকেরা মনে করতে থাকে। আর এও একটি বিদআত।

জাবের (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “ হামদ ও সানা তথা আল্লাহর প্রশংসার পরে মনে রাখবে, সর্বোত্তম কথা হল, আল্লাহর কিতাব আর সর্বোত্তম নিয়ম-পদ্ধতি হল, মুহাম্মাদ (ﷺ) এর নিয়ম-পদ্ধতি। আর সবচেয়ে খারাপ কাজ হল, বিদআত তথা দ্বীনে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা। আর প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী।” (মুসলিম)

ইরবায ইবনু সারিয়াহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, দ্বীনে নব আবিস্কৃত বিষয়াদী থেকে বাঁচ। কেননা, প্রত্যেক বিদআত তথা দ্বীনে নব আবিস্কৃত বিষয় গোমরাহী। (ইবনু মাজাহ, সহীহ)

আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) বলেন, “সকল বিদআত গোমরাহী। যদিও লোকজন তাকে আপাত দৃষ্টিতে ভালো মনে করে।” (দারিমী)

বিদআতীকে সহযোগিতাকারীর উপর আল্লাহর অভিশাপঃ

আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুরাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “আল্লাহ অভিশাপ করেছেন সেই ব্যক্তিকে যে আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারো নামে জন্তু জবেহ করে। আর যে জমির সীমা চুরি করে। আর যে মাতা পিতাকে অভিশাপ দেয়। আর যে বেদআতীকে আশ্রয় দেয়। (মুসলিম)

বিদআতীর আ‘মাল আল্লাহর কাছে অগ্রাহ্যঃ

আয়েশা (রাঃ) রাসূলুরাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করল যা দ্বীনে নেই সে কাজটি আল্লাহ কাছে পরিত্যজ্য।” (বুখারী ও মুসলিম)

বিদআতীর তোওবা গ্রহনযোগ্য হবে না যতক্ষণ না সে বেদআত সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়ঃ

আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুরাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “আল্লাহ তাআলা বিদআতীর তোওবা গ্রহণ করেন না যতক্ষণ না সে বিদআত থেকে সম্পূর্ণরূপে তওবা করে।” (তবরানী, সনদ হাসান)

বিদআত থেকে যে কোন উপায়ে বাঁচার আদেশ রয়েছেঃ

ইরবায ইবনু সারিয়া বলেন, রাসূলুরাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন. লোক সকল! তোমরা বিদআত থেকে বাঁচ”। (কিতাবুস সুন্নাহ ইবনু আবী আসিম)

কিয়ামতের দিন বিদআতী হাওযে কাউছারের পানি থেকে বঞ্চিত হবেঃ

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কিয়ামতের দিন বিদআতী লোকদের থেকে বেশী অসন্তুষ্টি প্রকাশ করবেন। সাহাল ইবনু সাআদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আমি হাওযে কাওছারে তোমাদের অপেক্ষায় থাকব। যে ব্যক্তি সেখানে আসবে সে পানি পান করবে। আর যে ব্যক্তি একবার পানি পান করবে তার কখনো তৃষ্ণা থাকবে না। কিছু লোক এমন আসবে যাদেরকে আমি চিনব। তারাও আমাকে চিনবে। আমি মনে করব তারা আমার উম্মত তার পরও তাদেরকে আমার নিকট পর্যন্ত পৌঁছতে হবে না। আমি বলব এরা তো আমার উম্মত। আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মদ! আপনি জানেন না আপনি দুনিয়া থেকে চলে আসার পর এসব লোকেরা কেমন কেমন বিদআত সৃষ্টি করেছে। তার পর আমি বলব, “দূর হোক, দূর হোক সে সকল লোকেরা যারা আমার পর দ্বীন পরিবর্তন করেছে। (বুখারী ও মুসলিম)

বিদআত সৃষ্টিকারীর প্রতি আল্লাহর ফেরেশ্তা সমূহ এবং সব লোকের অভিশাপ হয়ে থাকেঃ

আসেম (রাহঃ) বলেন, আনাস (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কি মদীনাকে হারাম আখ্যা দিয়েছেন? তিনি বললেন হাঁ। উমুক স্থান থেকে উমুক স্থান পর্যন্ত । এ স্থানের কোন গাছ কাটা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি এখানে কোন বিদআত সৃষ্টি করবে তার উপর আল্লাহ ফেরেশ্তা এবং লোক সকলের অভিশাপ হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

বিদআত প্রচলনকারী নিজের গুনাহ ব্যতিত তার সৃষ্ট বিদআত মতে আমলকারী সব লোকের গুনাহের একটি ভাগ পাবেঃ

কাসীর ইবনু আব্দুল্লাহ রহঃ বলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমর সুন্নাত থেকে কোন একটি সুন্নাহ কে জীবিত করেছে আর অন্য লোকেরা সে মতে আ‘মাল করেছে তাকে সব আমলকারীর সমান সাওয়াব দেয়া হবে। আবার তাদেরকেও কম দেয়া হবে না। আর যে ব্যক্তি কোন বিদআত চালু করেছে এবং লোকেরা সে মতে আ‘মাল করেছে তাকে সব আমলকারীর সমান পাপ দেয়া হবে। আবার তাদের পাপে কম করা হবে না। (ইবনে মাজাহ, সনদ সহীহ)

আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি লোক জনকে হেদায়েতের দিকে আহবান করবে তাকে সে হেদায়াত মতে আমলকারী সব লোকের সোওয়াব দেয়া হবে। আর লোকজনের সোওয়াবেও কোন কম করা হবে না। এমনি ভাবে যে ব্যক্তি লোকজনকে গোমরাহীর দিকে আহবান করবে তাকে সে গোমরাহী মতে আ‘মাল কারীর সব লোকের সমান পাপ দেয়া হবে । আবার লোক জনের পাপেও কোন কম করা হবে না। (মুসলিম)

আব্দুল্লাহ ইবনু উমর রাঃ কোন বেদআতী লোকের সালামের উত্তর দিতেন নাঃ

নাফে (রাঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) এর কছে এক ব্যাক্তি এসে বলল, উমুক লোক আপনাকে সালাম বলেছেন। ইবনু উমার (রাঃ) বললেন, আমি শুনেছি সে নাকি বিদআত আবিস্কার করেছে। যদি তা ঠিক হয় তাহলে তাকে আমার পক্ষ থেকে সালাম বলনা। (তিরমিযী, সনদ সহীহ)

বিদআত গ্রহণকারী ব্যক্তিদের কে সুন্নাহ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়ঃ

হাসান ইবনু আতিয়া বলেন, যে ব্যক্তি দ্বীনে কোন বিদআত গ্রহণ করবে আল্লাহ তাআলা তার থেকে ততটুকু সুন্নাহ ঊঠিয়ে নিবেন। তার পর কিয়ামত পর্যন্ত তাদের মধ্যে সে সুন্নত ফিরিয়ে দেয়া হয় না। (দরেমী, সনদ ১০/১৩/২০১১সহীহ)

অন্য গুনাহের চেয়ে বিদআত শয়তানের কাছে অধিক প্রিয়ঃ

সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, শয়তান পাপের পরিবর্তে বিদআতকে বেশি পছন্দ করে। কারণ পাপ থেকে তো লোকেরা তওবা করে নেয় কিন্তু বিদআত থেকে তওবা করে না। (শরহুস সুন্নাহ)

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাঃ বিদআতীদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দিয়েছেনঃ

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) জানতে পারলেন যে, কিছু লোক মসজিদে একত্রিত হয়ে উচ্চস্বরে যিকির এবং দরুদ শরীফ পড়তে ছিলেন। তিনি তাদের কাছে আসলেন এবং বললেন, আমরা রাসূল (ﷺ) এর যামানায় এরূপভাবে যিকির করতে বা দুরূদ পড়তে কাউকে দেখিনি। অতএব আমি তোমাদেরকে বেদআতী মনে করি। তিনি এ কথাটি বারবার বলেছিলেন, এমনকি তাদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দিলেন। (আবূ নুআইম)

মুহাদ্দিসগণের নিকট বিদআতীদের হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়ঃ

মুহাম্মাদ ইবনু সিরীন (রহ) বলেন, প্রথম প্রথম লোকেরা হাদীসের সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত না কিন্তু যখন ফেতনা, বেদআত ও মন গড়া বর্ণনা প্রসার হতে লাগল তখন হাদীসের সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা অপরিহার্য হয়ে গেল। যদি হাদীস বর্ণনাকারী আহলে সুন্নাহ হয়, তাহলে তা গ্রহণ করা হয় আর যদি বর্ণনাকারী বিদআতপন্থি হয় তাহলে তার হাদীস গ্রহণ করা হয় না। (মুসলিম)

বিদআত ফিতনায় পতিত হওয়া বা কষ্ট দায়ক শাস্তিযোগ্য হওয়ার বড় কারণঃ

ইমাম মালেক রাহঃ কে জিজ্ঞাসা করা হল হে আবু আব্দল্লাহ! ইহরাম কোথা থেকে বাঁধব? আমি মসজিদে নববী তথা কবর শরীফের কাছ থেকে ইহরাম বাঁধতে চাই। উত্তরে ইমাম মালেক বললেন, এরূপ কর না। আমার ভয় হয়, হয়ত তুমি ফিতনায় পতিত হবে। লোকটি বলল, এখানে ফিতনার কী আছে? আমি তো শুধু কয়েক মাইল পূর্বে ইহরাম বাঁধতে চাইছি।ইমাম মালেক বললেন, এর চেয়ে বড় ফিতনা আর কি হবে যে, তুমি মনে করছ যে ইহরাম বাঁধার সোওয়াব রাসূল (ﷺ) থেকে আগে বেড়ে যাচ্ছ। আল্লাহ তাআলা বলেন, “যারা আল্লাহ তায়ালার আদেশ অমান্য করে তাদের ভয় থাকা উচিৎ যেন তারা কোন ফিত্না বা কষ্ট দায়ক শস্তিতে পতিত না হয়। (আল ইতিসাম)

দ্বীনের ব্যাপারে নিজের খেয়াল খুশী বা মনের চাহিদা মতে চলা থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা উচিৎঃ

আবূ বারআ আসলামী রাঃ বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, আমি আমার পরে তোমাদের ব্যাপারে পেট, লজ্জাস্থান, এবং বিপথগামী মন বাসনাকে ভয় করছি। (কিতাবুস সুন্নাহ ইবনু আবী আছিম। সহীহ)

বিদআতপন্থী লোকের কোন নেক আ‘মাল গ্রহণযোগ্য হবে নাঃ

ফুযাইল ইবনু আয়ায (রহ.) বলেন, যখন তোমরা বিদআতপন্থী কোন লোক আসতে দেখবে সে রাস্তা ছেড়ে অন্য রাস্তা গ্রহণ করবে। বিদআতীর কোন আ‘মাল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। যে ব্যক্তি বিদআতপন্থীকে সহযোগিতা করল সে যেন দ্বীন ধ্বংস করতে সহযোগিতা করল। (খাছায়িছূ আহলিস সুন্নাহ)

বিদআত সম্প্রসারণের কয়েকটি কারণ:

১) অন্ধ অনুকরণঃ শাষকবর্গের অনুকরণার্থে মাযারে উপস্থিতি, ফাতেহাখানী, কুরআনখানী, জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী, নিরবতা পালন, ওরস ইত্যাদি।

২) বুযুর্গ ব্যক্তিদের অতি ভক্তিঃ উপমহাদেশে সূফীগণ ইসলামের দাওয়াত নিয়ে পৌঁছলেন যখন তারা উপলব্ধি করেন যে, এখানে জনসাধারণ গান-বাজনা ও সঙ্গীতকে খুবই পছন্দ করেন তখন সূফীগণ দাওয়াতের স্বার্থে শ্যামা ও কাওয়ালীর প্রথা চালু করেন।

৩) মতবিরোধ পূর্ণ মাসায়েলের ধোকাঃ দাওয়াতের ক্ষেত্রে কিছু কিছু লোক মতপার্থক্য সৃষ্টি করে। যেমন, নামাযে রফয়ে ইয়াদইন (উভয় হাত উঠানো), উচ্চস্বরে আমীন বলা। আবার কেউ সহীহ হাদীস দূরের কথা যঈফ হাদীস ও নাই যেমন, ফাতেহা প্রথা, কুলখানী প্রথা, দশরী, চল্লিশা, গেয়ারবী, কুরআন খানী, মীলাদ, বার্ষিকী পালন, কাওয়ালী, সুন্দলমালী, আলোক সজ্জা, কুন্ডা, ঝান্ডা, ইত্যাদি। এ সকল বিদআত কে ইখতেলাফী মাসায়েল বা মতবিরোধপূর্ণ বিষয় বলে উড়িয়ে দেয়া মূলত দ্বীনের মধ্যে বিদআত প্রচারে উদ্বুদ্ধ করা।

৪) সহীহ সুন্নাহ থেকে অজ্ঞতাঃ রাসূল (ﷺ) এর বিধানাবলী মেনে চলা যেহেতু সকল মুসলিমের উপর ফরয তাই অধিকাংশ লোকেরা রাসূল (ﷺ) এর নামে বর্ণিত প্রত্যেক কথাকে সুন্নত মনে করে আ‘মাল শুরু করে দেন। এমন লোক খুব কমই আছেন যারা এ কথা জাচাই-বাছাই করাকে অবশ্যক মনে করেন যে, রাসূল (ﷺ) এর নামে বর্ণিত কথাটি কি সত্যিই তাঁর কথা? না তার নামে ভূল নেসবত করা হয়েছে? জন সাধারণের এই দূর্বলতা তথা অজ্ঞতার কারণে অনেক বিদআত ও কুসংস্কার সমাজে প্রচলিত হয়ে গেছে। যাকে লোকেরা সৎ উদ্দেশ্যে দ্বীন বুঝে প্রতিনিয়ত পালন করে আসছে। আমার জানামতে এমন অনেক লোক রয়েছে যারা সহীহ ও যঈফ হাদীসের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারার পর গায়রে মাসনূন কাজ বাদ দিয়ে সুন্নাত সমর্থিত কাজ ধরতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেন নি।

রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জেনে শুনে আমার প্রতি মিথ্যা কথা নেসবত করবে সে যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকান করে নেয়।” (মুসলিম)

অতএব জনগণকে পথ প্রদর্শনের কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের গুরু দায়িত্ব হল, তার যেন পরিপূর্ণ জাচাই বাছাইয়ের পর সহীহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত মাসায়েলগুলি কেবল জনগণকে বলেন। আর জনগণের বড় দায়িত্ব হল, তারা রাসূল (ﷺ) এর নামে নেসবতকৃত কথাকে ততক্ষণ সুন্নাত বলে গ্রহণ করবে না যতক্ষণ না তাত তার দিকে নেসবতকৃত কথা ও কাজটি বাস্তবে তারই কথা বলে প্রমাণিত হবে।

৫) রাজনৈতিক স্বার্থঃ বর্তমানে আমাদের দেশে অধিকাংশ ধর্মীয় রাজনৈতিক দল নিজেদের দলীয় সমর্থন বৃদ্ধি করা বা ভোট বেশি পাওয়ার স্বার্থে বিভিন্ন সময় শিরক-বিদআত বা অপসংস্কৃতির সাথে আপোষ করতেও দ্বিধা করে না। যে দলগুলো নিজেদের জ্ঞানানুসারে র্শিক-বিদআতের বিভিষিকা সম্পর্কে সঠিক উপলদ্ধি রাখেন তারা শুধু জনসাধারণের অসন্তুষ্টিকে এড়ানোর জন্য বিভিন্ন টাল-বাহানার মাধ্যমে এ ব্যাপারে চুপ থাকা বা সত্যকে গোপন করার নিয়ম অবলম্বন করে আছেন। কখনো বলেন, এটাও বৈধ, ওটাও বৈধ, তবে না করাই বেশি উত্তম ছিল। আবার কখনো বলেন, অমুক ব্যক্তি এটাকে অবৈধ মনে করতেন কিন্তু অমুকের নিকট এটি বৈধ ইত্যাদি…. আরো অনেক রকমের কথা। এই পদ্ধতি জন সাধরণের অন্তরে মাসনূন সুন্নাহ ও গায়রে মাসনুন সন্নাহকে সংমিশ্রণ করে সুন্নাতের গুরুত্বকে একেবারে শেষ করে দিয়েছে। তারা মূলতঃ বিদআতের প্রচার-প্রসারের পথকেই সুগম করে দিয়েছে।

কোন কোন মুবাল্লিগ যারা ক্ষমতার মসনদে বসে শিরক ও বিদআতের নিন্দা করতেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তারাও অনেক র্শিকও বিদআতের কাজে লিপ্ত হচ্ছেন। কোন কোন আলিম যারা কিতাব সুন্নাতের ঝান্ডাবাহী ছিলেন তারাও রাজনৈতিক অপারগতার নামে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গের শক্তি বৃদ্ধি কারণ হয়ে যাচ্ছেন। এমনিভারে কিছু ধর্মীয় পথ প্রদর্শকগণ যারা জাতিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রতি আহবান করতেন তারা নিজেরাই অন্যায় গ্রহণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে মগ্ন। রাজনৈতিক স্বর্থের নামে এ সকল ধর্মীয় দল এবং কতিপয় আলিমদের কথা ও কাজের এই বৈপরিত্ব শিরক-বিদআতের বিরুদ্ধে অতীতে কৃত দীর্ঘ প্রচেষ্টাকে খুব বেশী ক্ষতি করেছে।

উপসংহারঃ তাই পরিশেষে আহবান জানাই, আসুন দ্বীনের মধ্যে নিত্য নতুন বিদআতী কাজ কর্ম থেকে সতর্কতা অবলম্বন অবলম্বন করি। সেই সাথে নিজেদের নিকট আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং সর্বপরি দেশের মুসলিম ভাইদেরকে এই সব ঘৃণ্য বিদআত থেকে সাবধান থাকার জন্য আহবান করি। আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার শিরক ও বিদআত থেকে দূরে থেকে তাওয়াহ্‌য়ীদ ও সুন্নহার আলোকে দ্বীনের পথে জীবন অতিবাহিত করার তাওফীক দান করুন। আমীন।