দীনে ইসলামে বিদআতের ক্ষতি ও কুপ্রভাব

সংকলন : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
সম্পাদনা : ইকবাল হোছাইন মাছুম
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

আল্লাহ তাআলা বলেন :

অতঃপর সত্যের পর ভ্রষ্টতা ছাড়া কী থাকে? (সূরা ইউনুস আয়াত : ৩২)

আয়াত থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. এ আয়াতে হক তথা সত্য বলতে দীনে ইসলামকে বুঝনো হয়েছে।

দুই. ইসলাম পূর্ণতা লাভ করার পর ইসলামের নামে দীনের মধ্যে যা কিছু সংযোজিত, আবিস্কৃত ও প্রচলিত হবে সব কিছুই ভ্রান্ত বলে প্রত্যাখ্যাত হবে। আর তা বিদআত বলে গণ্য হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

আমি এ কিতাবে কোন কিছু বাদ রাখিনি। (সূরা আনআম, আয়াত : ৩৮)

আয়াত থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে সব কিছু যখন বলে দিয়েছেন তখন ধর্মে নতুন কোন বিষয় সংযোজন বা বিয়োজন করার প্রয়োজন নেই। যে কোন ধরনের সংযোজন ও বিয়োজনই বিদআত বলে গণ্য হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ করাও। (সূরা নিসা, আয়াত : ৫৯)

আয়াত থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. যখন কোন বিষয়ে মত বিরোধ সৃষ্টি হবে তখন তার সমাধান আল্লাহ তাআলার কিতাব কুরআনুল কারীম ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর হাদীসে খুঁজতে হবে।

দুই. আল্লাহর বিধানে সমাধান না খুঁজে নিজেদের পক্ষ থেকে যুক্তি দিয়ে কোন বিষয় সংযোজন ও বিয়োজন করা যাবে না। কুরআন-সুন্নাহর মূল ধারার বাইরে কোন ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যাবে না।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

আর এটি তো আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। (সূরা আনআম, আয়াত : ১৫৩)

আয়াত থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. আয়াতটি সূরা আনআমে বর্ণিত আল্লাহ তাআলার দশটি নির্দেশের একটি।

দুই. আল্লাহ তাআলা যা কিছু করতে বলেছেন। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে যা কিছু প্রমাণিত, সেটা হল সঠিক পথ। আর যা কিছু প্রমাণিত নয় তা অনুসরণ করা যাবে না। কারণ তা বক্র পথ। সে পথে আছে বিভ্রান্তি।

তিন. সত্য, সঠিক ও সরল পথ একটিই। আর তা হল ইসলাম। ইসলাম বাদে আছে আরও অনেক পথ। কিন্তু সেগুলো সত্য, সঠিক ও সরল নয়। সেগুলো বিদআত।

আল্লাহ তাআলা বলেন :

বল, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১)

আয়াত থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল:

এক. আল্লাহ তাআলাকে ভালবাসার দাবী হল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে অনুসরণ করা। যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণ পরিত্যাগ করে সে মূলত: আল্লাহকে ভালবাসে না।

দুই. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে অনুসরণ করে আল্লাহ তাআলাকে ভালবাসলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ভালবাসা লাভ করা যাবে।

তিন. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণ আল্লাহকে ভালবাসার প্রমাণ।

চার. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণ করলে আল্লাহ তাআলার ভালবাসা পাওয়ার সাথে সাথে তাঁর ক্ষমা লাভ করা যাবে।

পাঁচ. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণের দাবী হল, সকল প্রকার বিদআত পরিহার করা। বিদআত থেকে দূরে থাকা। কারণ, তিনি বিদআতে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছেন।

হাদীস – ১.

عن عائشةَ ، رضي اللَّه عنها ، قالت قال رسولُ اللَّه صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم : ্র منْ أَحْدثَ في أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فهُو رَدٌّ গ্ধ متفقٌ عليه . وفي رواية لمسلمٍ : ্র مَنْ عَمِلَ عمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُو ردٌّ গ্ধ .

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমাদের এ বিষয়ে (ধর্মীয় বিষয়ে) এমন কিছু সৃষ্টি করবে যা এর থেকে (প্রমাণিত) নয়, তা প্রত্যাখ্যাত। (বুখারী ও মুসলিম)

মুসলিমের একটি বর্ণনায় এসেছে : যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করবে যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত।

হাদীস থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল :

এক. বিদআত ইসলামে নিষিদ্ধ। ইহুদী ও খৃষ্টধর্মসহ অন্যান্য আসমানী ধর্মগুলো বিদআতের কারণেই নি:শেষ হয়ে গেছে। ধর্মে নতুন বিষয় প্রচলন করার কারণে এ সব ধর্মের মূল কাঠামো আর অবশিষ্ট থাকেনি।

দুই. আলোচ্য হাদীসে ‘আমাদের এ বিষয়ের মধ্যে’ বাক্য দ্বারা ইসলামের ধর্মীয় বিষয় বুঝানো হয়েছে। ইসলামের ধর্মীয় আচার-আচরণে কোন নতুন বিষয় সংযোজন, প্রচলন, আবিস্কার করা যাবে না। অতএব জাগতিক ও পার্থিব বিষয়ে নতুন আবিস্কার, উদ্ভাবন বা নতুন কিছুর প্রচলন নিষিদ্ধ ও প্রত্যাখ্যাত নয়।

তিন. ধর্মে নতুন বিষয় প্রচলন করা, আবিস্কার করা যেমন অন্যায়, তেমনি এর অনুসরণ করে তা পালন করাও অন্যায়।

হাদীস – ২.

عن جابرٍ ، رضي اللَّه عنه ، قال : كان رسولُ اللَّه صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم ، إِذَا خَطَب احْمرَّتْ عيْنَاهُ ، وعَلا صوْتُهُ ، وَاشْتَدَّ غَضَبهُ ، حتَّى كَأَنَّهُ مُنْذِرُ جَيْشٍ يَقُولُ : ্রصَبَّحَكُمْ ومَسَّاكُمْ গ্ধ وَيقُولُ : ্র بُعِثْتُ أَنَا والسَّاعةُ كَهَاتيْن গ্ধ وَيَقْرنُ بين أُصْبُعَيْهِ ، السبَابَةِ ، وَالْوُسْطَى ، وَيَقُولُ: ্র أَمَّا بَعْدُ ، فَإِنَّ خَيرَ الْحَديث كِتَابُ اللَّه ، وخَيْرَ الْهَدْى هدْيُ مُحمِّد صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم ، وَشَرَّ الأُمُورِ مُحْدثَاتُهَا وكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلالَةٌ গ্ধ ثُمَّ يقُولُ : ্র أَنَا أَوْلَى بُكُلِّ مُؤْمِن مِنْ نَفْسِهِ . مَنْ تَرَك مَالا فَلأهْلِهِ ، وَمَنْ تَرَكَ دَيْناً أَوْ ضَيَاعاً، فَإِليَّ وعَلَيَّ গ্ধ رواه مسلم .

জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন খুতবা দিতেন তখন তাঁর চক্ষুদ্বয় লাল হয়ে যেত। কন্ঠস্বর উচ্চ হয়ে যেত। রাগত ভাব প্রচন্ডভাবে প্রকাশ পেত। মনে হত তিনি কোন সৈন্যবাহিনীকে সতর্ক করছেন যে, সকালে বা বিকালেই শত্রু বাহিনী এসে পড়বে। তিনি আরো বলতেন, আমি আর কেয়ামত এমন নিকটবর্তী, এ কথা বলে মধ্যমা ও তর্জনী আঙ্গুল দুটো একত্র করতেন। তিনি আরো বলেনঃ জেনে রাখ! সবচেয়ে ভাল কথা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। আর সর্বোত্তম আদর্শ হচ্ছে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আদর্শ। আর ধর্মের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে ধর্মে নতুন সৃষ্টি। (এটা বিদআত) আর সব বিদআতই পথভ্রষ্টতা।

তারপর তিনি বলেনঃ আমি প্রত্যেক মুমিনের নিকট তার প্রাণের চেয়ে আপন। যে ব্যক্তি কোন সম্পদ রেখে মারা যায়, তা তার পরিবারের জন্য। আর যে ব্যক্তি কোন ঋণ অথবা অসহায় সন্তান রেখে মারা যায়, তাহলে তাদের দায়িত্ব আমার উপরই। (মুসলিম)

হাদীস থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল :

এক. রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খুতবা ও ভাষণ দানের পদ্ধতি জানা গেল। তিনি উচ্চ কন্ঠে, একজন বীর সেনাপতির মত ভাষণ দিতেন। আর এভাবে খুতবা প্রদান সুন্নত, তাতে সন্দেহ নেই।

দুই. কেয়ামত আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমন খুবই নিকটবর্তী। মানে এর মধ্যবর্তী সময়ে আর কোন নবী বা রাসূলের আগমন ঘটবে না।

তিন. খুতবা বা ভাষণে হাত দিয়ে ইশারা-ইঙ্গিত করা সুন্নত।

চার. সর্বোত্তম কথা ও সর্বোত্তম আদর্শ সম্পর্কে জানতে পারলাম। একইভাবে সবচেয়ে খারাপ বিষয় সম্পর্কেও জানতে পারলাম। আর তা হল বিদআত। কারণ, সকল বিদআতই মানুষকে পথভ্রষ্ট করে। যেমন খৃষ্ট ধর্মে বিদআত খৃষ্টানদেরকে পথভ্রষ্ট করে পৌত্তলিকতায় লিপ্ত করেছে।

পাঁচ. প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তির কাছে তার প্রাণ যেমন আপন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার চেয়েও আপন।

ছয়. তিনি এই খুতবাতে ইসলামী রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি বর্ণনা করলেন। তা হল, কোন ব্যক্তি ঋণ রেখে মারা গেলে তা আদায় করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এমনিভাবে অসহায় সন্তান রেখে মারা গেলে তার লালন-পালনের দায়িত্বও পালন করবে রাষ্ট্র। কিন্তু যদি কোন সম্পদ রেখে মারা যায় তা পাবে তার পরিবারের লোকজন। রাষ্ট্র বা সরকার তা গ্রহণ করতে পারবে না।

সাত. জুমার খুতবায় লোকদেরকে বিদআত সম্পর্কে সতর্ক করা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একটি সুন্নাত।

বিদআত প্রসঙ্গে আরেকটি হাদীস –

عَنْ أَبِي نَجِيحٍ الْعِرْباضِ بْنِ سَارِيَة رضي اللَّه عنه قال : وَعَظَنَا رسولُ اللَّه صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم مَوْعِظَةً بليغةً وَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ وَذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُون ، فقُلْنَا : يا رَسولَ اللَّه كَأَنَهَا موْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَأَوْصِنَا . قال : ্র أُوصِيكُمْ بِتَقْوى اللَّه، وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وإِنْ تَأَمَّر عَلَيْكُمْ عَبْدٌ حبشيٌ ، وَأَنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ فَسَيرى اخْتِلافاً كثِيرا . فَعَلَيْكُمْ بسُنَّتي وَسُنَّةِ الْخُلُفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ ، عضُّوا عَلَيْهَا بالنَّواجِذِ ، وإِيَّاكُمْ ومُحْدثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضلالَةٌ গ্ধ رواه أبو داود ، والترمذِي وقال حديث حسن صحيح .

আবু নাজীহ ইরবাজ ইবনে সারিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের উদ্দেশ্যে এমন এক বাগ্মীতাপূর্ণ ভাষায় ওয়াজ করলেন, তাতে আমাদের হৃদয় সন্ত্রস্ত হয়ে গেল আর চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল। আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা যেন আপনার বিদায়ী উপদেশ। আপনি আমাদের আরো উপদেশ দিন। তিনি বললেন: আমি আল্লাহর ব্যাপারে তাকওয়া অবলম্বনের জন্য তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি। আরো উপদেশ দিচ্ছি, তোমরা তোমাদের নেতার অনুসরণ ও আনুগত্য করবে। যদি হাবশী গোলাম তোমাদের আমীর নির্বাচিত হয়, তবুও। আর তোমাদের মধ্যে যে জীবিত থাকবে সে অনেক মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমাদের কর্তব্য হবে, আমার সুন্নাত আঁকড়ে ধরা ও স পথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ অনুসরণ করা। এ সুন্নাত ও আদর্শকে খুব মজবুতভাবে ধারণ করবে। আর (ধর্মের মধ্যে) সকল প্রকার নবসৃষ্ট বিষয় থেকে দূরে থাকবে। জেনে রাখো, প্রত্যেকটি বিদআতই পথভ্রষ্টতা। (আবু দাউদ, তিরমিজি)

হাদীস থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল :

এক. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এমন ভাষায় ও ভঙ্গিতে ওয়াজ করতেন যাতে শ্রোতাদের চোখে পানি এসে যেত।

দুই. সাহাবায়ে কেরাম সর্বদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওয়াজ-নসীহত, খুতবা-বক্তৃতা শোনার জন্য উদগ্রীব থাকতেন। এতে তারা কখনো ক্লান্তি বোধ করতেন না।

তিন. তাকওয়া বা সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ ভীতির নীতি অনুসরণ করার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সর্বদা উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রতিটি ভাষণ ও খুতবাতে তিনি তাকওয়া অবলম্বন করার উপদেশ দিতেন।

চার. শাসকদের আনুগত্য করা ইসলামে অপরিহার্য। তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারন করা, বিদ্রোহ করা, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া, তাদের আনুগত্য থেকে বের হওয়া ইত্যাদি গুরুতর পাপ। তবে তাদের সংশোধনের জন্য কাজ করা, আনুগত্যের মধ্যে থেকে সংশোধনের উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের অন্যায়গুলোর সমালোচনা করা দোষের কিছু নয়।

পাঁচ. শাসক যদি অযোগ্য, অপদার্থ হয় তবুও তার আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাওয়া যাবে না। কারণ মুসলিম অথারিটি ইসলামের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদি মুসলিমদের নেতৃত্ব দেয়ার মত অথারিটি না থাকে তাহলে ইসলামের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। প্রত্যেকে যার যার খুশী মত ইসলাম অনুসরণ করবে। ফলে ইসলামের একটি অভিন্ন রূপ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ছয়. সর্বক্ষেত্রে একজন মুসলিম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহ অনুসরণ করবে। তারপর খোলাফায়ে রাশেদীন -আবু বকর (রাঃ) উমার (রাঃ) উসমান (রাঃ) ও আলী (রাঃ)- এর আদর্শ অনুসরণ করবে। আর যখন কোন বিষয়ে মতভেদ দেখা দিবে তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহর অনুসরণ আরো জরুরী হয়ে পড়ে। আর সুন্নাহ অনুসরণ করার মাধ্যমে ইখতেলাফ দূর হয়ে উম্মতের মধ্যে ঐক্য কায়েম হতে পারে। তাই কুরআন ও সুন্নাহ হল ইসলামী ঐক্যের মূলভিত্তি। আর বিদআত হল উম্মতকে বিভক্ত করার একটি বড় মাধ্যম।

সাত. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তার খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শের বিপরীত যা কিছু ধর্ম হিসাবে চালু হবে তার নাম বিদআত। বিদআত হল সুন্নাহর বিপরীত। বিদআত ইসলামে একটি মারাত্মক অপরাধ।

আট. এ হাদীসে বিদআত থেকে দূরে থাকার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সকলকে সতর্ক করেছেন। বিদআত হল, ধর্মের নামে ধর্মের মধ্যে নতুন আবিস্কৃত বিষয়। যা আল্লাহ বলেননি, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাহ দ্বারা যা প্রমাণিত নয়, সাহাবায়ে কেরামের কেউ যা করেননি তা দীনি বা সওয়াবের কাজ বলে আ‘মাল করার নাম হল বিদআত। বিদআত যেমন কর্মে হয় তেমনি আকীদা- বিশ্বাসেও হয়ে থাকে।

নয়. ‘ধর্মের জন্য নতুন বিষয়ের প্রচলন’ আর ‘ধর্মের মধ্যে নতুন বিষয়ের প্রচলন’ এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথমটি বিদআত নয়। দ্বিতীয়টি বিদআত। প্রথমটি উদাহরণ হিসাবে আজকের যুগের মাদরাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আজান ও স্বলাতে মাইক ব্যবহার, ইসলামের দাওয়াতে টিভি, ইন্টারনেট ইত্যাদির ব্যবহার পেশ করা যেতে পারে। এগুলো সব ধর্মের জন্য প্রচলন করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় প্রকারের উদাহরণ হিসাবে মীলাদুন্নবী উদযাপন, শবে বরাত পালন, ওরস অনুষ্ঠান ইত্যাদি পেশ করা যেতে পারে। এগুলো হল ধর্মের মধ্যে নতুন আবিস্কার।

বিদ’আত সম্পর্কে আরো কিছু কথা

বিদআত কাকে বলে এ বিষয়ে অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। অনেকের ধারণা যা আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর যুগে ছিল না তা-ই বিদআত। আবার অনেকে মনে করেন বর্তমান নিয়মতান্ত্রিক মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতি একটি বিদআত, তাবলীগ জামাতের পদ্ধতি বিদআত, বিমানে হজ্জে যাওয়া বিদআত, মাইকে আজান দেয়া বিদআত ইত্যাদি। এ সকল দিক বিবেচনা করে তারা বিদআতকে নিজেদের খেয়াল খুশি মত দুই ভাগ করে কোনটাকে বিদআতে হাসানাহ (ভাল বিদআত) আবার কোনটাকে বিদআতে সাইয়্যেআহ (মন্দ বিদআত) বলে চালিয়ে দেন। আসলে বিদআত সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে এ বিভ্রান্তি।

বিদআতের আভিধানিক অর্থ হল :

الشئ المخترع على غير مثال سابق ومنه قوله تعالى (قل ما كنت بدعا من الرسل) وجاء على هذا المعنى قول عمر رضى الله عنه (نعمت البدعة)

অর্থ : পূর্বের দৃষ্টান্ত ব্যতীত নতুন সৃষ্ট কোন বিষয় বা বস্তু। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন : “বলুন, আমি তো কোন নতুন রাসূল নই।”

আসলে মুহাম্মাদ (ﷺ) রাসূল হিসাবে নতুনই। কিন্তু এ আয়াতে বিদআত শব্দের অর্থ হল এমন নতুন যার দৃষ্টান্ত ইতোপূর্বে গত হয়নি। আর উমার (রাঃ) তারাবীর জামাত কায়েম করে বলেছিলেন “এটা উত্তম বিদআত।” এখানেও বিদআতের আভিধানিক অর্থ প্রযোজ্য।

ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় বিদআতের সংজ্ঞা হল : ما أحدث في دين الله وليس له أصل عام ولا خاص يدل عليه

‘আল্লাহর দ্বীনে যা কিছু নতুন সৃষ্টি করা হয় অথচ এর সমর্থনে কোন ব্যাপক বা বিশেষ দলীল-প্রমাণ নেই।’

অর্থাৎ, নব সৃষ্ট বিষয়টি অবশ্যই ধর্মীয় ব্যাপারে হতে হবে। যদি ধর্মীয় ব্যাপার ব্যতীত অন্য কোন বিষয়ে নব-আবিস্কৃত কিছু দেখা যায় তা শরীয়তের পরিভাষায় বিদআত বলে গণ্য হবে না, যদিও শাব্দিক অর্থে বিদআত।

এ প্রসঙ্গে আবুল হাসান আলী নদভী রহ. তার ‘র্শি ক ও বিদআত’ কিতাবে বিদআতের পরিচ্ছন্ন সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন। তা হল : যে বিশ্বাস বা কাজ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করেননি কিংবা পালন করার নির্দেশ দেননি সেই ধরনের বিশ্বাস বা কাজকে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করা, এর অঙ্গ বলে সাব্যস্ত করা, সওয়াব বা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় মনে করে এই ধরনের কাজ করার নাম বিদআত।

যে সকল বিশ্বাস ও কাজকে দ্বীনের অংশ মনে করে অথবা সওয়াব হবে ধারণা করে আ‘মাল করা হয় তা বিদ’আত। কারণ হাদীসে এসেছে :

عن عائشة رضى الله عنها قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد. (أخرجه البخاري ومسلم)

অর্থ : আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে আমাদের এ ধর্মে এমন কোন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করবে যা ধর্মে অন্তর্ভুক্ত নয় তা প্রত্যাখ্যাত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

এ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট হল যে, নতুন আবিস্কৃত বিষয়টি যদি ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরে নেয়া হয় তাহলে তা বিদআত ও প্রত্যাখ্যাত হবে।

হাদীসে আরো এসেছে : من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد. (رواه مسلم)

অর্থ : যে ব্যক্তি এমন কাজ করবে যার প্রতি আমাদের (ইসলামের) নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত। (মুসলিম)

এ হাদীসে ‘যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই’ বাক্যটি দ্বারা এ কথা বুঝানো হয়েছে যে, বিষয়টি ধর্মীয় হতে হবে। ধর্মীয় বিষয় হিসাবে কোন নতুন আ‘মাল করলেই বিদআত হবে। যারা মাইকে আজান দেন তারা জানেন যে, মাইকে আজান দেয়ার আলাদা কোন মর্যাদা নেই বা আজানে মাইক ব্যবহার করা সওয়াবের কাজ বলে তারা মনে করেন না। এমনিভাবে বিমানে হজ্জে যাওয়া, প্রাতিষ্ঠানিক মাদ্রাসার প্রচলন, নাহু সরফের শিক্ষা গ্রহণ প্রভৃতি বিষয় ধর্মের অংশ বলে মনে করা হয় না, তাই তা বিদআত হওয়ার প্রশ্ন আসে না। এ ধরনের বিষয়গুলি বিদআত নয় বরং সুন্নাতে হাসানাহ বলা যেতে পারে।

অনেকে এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বিদআতকে দু’ভাগে ভাগ করার চেষ্টা করেন। বিদআতে হাসানাহ ও বিদআতে সাইয়্যেআহ। সত্যি কথা হল বিদআতকে এভাবে ভাগ করাটা হল আরেকটি বিদআত এবং তা রাসূল (ﷺ)-এর হাদীসের পরিপন্থী।

কেননা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন :

إياكم ومحدثات الأمور فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة. (رواه أبو داود و الترمذي وابن ماجه والبيهقي في السنن عن العرباض بن سارية.)

অর্থ : সকল নব-আবিস্কৃত (দীনের মধ্যে) বিষয় হতে সাবধান! কেননা প্রত্যেকটি নব-আবিস্কৃত বিষয় বিদআত, আর প্রত্যেকটি বিদআত হল পথভ্রষ্টতা। (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও বাইহাকী)

রাসূলে কারীম (ﷺ) বলেছেন সকল প্রকার বিদআত ভ্রষ্টতা। এখন যদি বলা হয় কোন কোন বিদআত আছে যা হাসানাহ বা উত্তম, তাহলে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ হাদীসবিরোধী হয়ে যায়। তাই তো ইমাম মালিক রহ. বলেছেন :

من ابتدع فى الإسلام بدعة يراها حسنة فقد زعم أن محمدا صلى الله عليه وسلم خان الرسالة، فإن الله سبحانه وتعالى يقول (اليوم أكملت لكم دينكم) فما لم يكن يومئذ دينا فلا يكون اليوم دينا.

অর্থ : যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোন বিদআতের প্রচলন করে আর এটাকে হাসানাহ বা ভাল বলে মনে করে, সে প্রকারান্তরে এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর পয়গাম পৌঁছাতে খিয়ানত করেছেন। কারণ আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেন : ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করে দিলাম।’ সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যা ধর্ম রূপে গণ্য ছিল না আজও তা ধর্ম বলে গণ্য হতে পারে না।

তাই বিদআতে হাসানাহ বলে কোন কিছু নেই। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যা বলেছেন আমরা তাই বলব; সকল প্রকার বিদআত গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা।

বিদআতে হাসানায় বিশ্বাসীরা যা কিছু বিদআতে হাসানাহ হিসাবে দেখাতে চান সেগুলো হয়ত শাব্দিক অর্থে বিদআত, শরয়ী অর্থে নয়। অথবা সেগুলো সুন্নাতে হাসানাহ। যে সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন :

من سن فى الإسلام سنة حسنة فله أجرها وأجر من عمل بها من بعده من غير أن ينقص من أجورهم شيء، ومن سن في الإسلام سنة سيئة فله وزرها ووزر من عمل بها من بعده من غير أن ينقص من أوزارهم شيء. (رواه مسلم عن جرير بن عبد الله رضي الله عنهما)

অর্থ : যে ব্যক্তি ইসলামে কোন ভাল পদ্ধতির প্রচলন করল সে তার সওয়াব পাবে এবং সেই পদ্ধতি অনুযায়ী যারা কাজ করবে তাদের সওয়াবও সে পাবে, তাতে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন খারাপ পদ্ধতি প্রবর্তন করবে সে তার পাপ বহন করবে, এবং যারা সেই পদ্ধতি অনুসরণ করবে তাদের পাপও সে বহন করবে, তাতে তাদের পাপের কোন কমতি হবে না। (মুসলিম)

এখানে একটা প্রশ্ন হতে পারে যে, শবে বরাত উদযাপন, মীলাদ মাহফিল, মীলাদুন্নবী প্রভৃতি আচার-অনুষ্ঠানকে কি সুন্নাতে হাসানাহ হিসাবে গণ্য করা যায় না? মাইকে আজান দেয়া, মাদ্রাসার পদ্ধতি প্রচলন, আরবী ব্যাকরণ শিক্ষা ইত্যাদি কাজগুলো যদি সুন্নাতে হাসানাহ হিসাবে ধরা হয় তাহলে শবে বরাত, মীলাদ ইত্যাদিকে কেন সুন্নতে হাসানাহ হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না?

পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, বিদআত হবে ধর্মীয় ক্ষেত্রে। যদি নতুন কাজটি ধর্মের অংশ মনে করে অথবা সওয়াব লাভের আশায় করা হয়, তাহলে তা বিদ’আত হওয়ার প্রশ্ন আসে। আর যদি কাজটি ধর্মীয় হিসাবে নয় বরং একটা পদ্ধতি হিসাবে করা হয় তাহলে তা বিদ’আত হওয়ার প্রশ্ন আসে না। যেমন ধরুন মাইকে আজান দেয়া। কেউ ই মনে করে না যে, মাইকে আজান দিলে সওয়াব বেশী হয় অথবা মাইক ছাড়া আজান দিলে সওয়াব হবে না। তাই স্বলাত ও আজানের ক্ষেত্রে মাইক ব্যবহারকে বিদআত বলা যায় না।

তাই বলতে হয় বিদআত ও সুন্নাতে হাসানার মধ্যে পার্থক্য এখানেই যে, কোন কোন নতুন কাজ ধর্মীয় ও সওয়াব লাভের নিয়্যতে করা হয়, আবার কোন কোন নতুন কাজ দ্বীনি কাজ ও সওয়াবের নিয়্যতে করা হয় না বরং সংশ্লিষ্ট কাজটি সহজে সম্পাদন করার জন্য একটা নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়।

যেমন আমরা যদি ইতিপূর্বে উল্লিখিত হাদীসটির প্রেক্ষাপটের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে, একবার মুদার গোত্রের কতিপয় অনাহারী ও অভাবগ্রস্থ লোক আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর কাছে এলো। তিনি স্বলাত আদায়ের পর তাদের জন্য উপস্থিত লোকজনের কাছে সাহায্য চাইলেন। সকলে এতে ব্যাপকভাবে সাড়া দিলেন। রাসূলে কারীম (ﷺ) সাহাবায়ে কিরামের আগ্রহ ও খাদ্য সামগ্রী দান করার পদ্ধতি দেখে বলেন :

‘যে ইসলামে কোন ভাল পদ্ধতি প্রচলন করল সে তার সওয়াব পাবে এবং সেই পদ্ধতি অনুযায়ী যারা কাজ করবে তাদের সওয়াবও সে পাবে, তাতে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন খারাপ পদ্ধতি প্রবর্তন করবে সে তার পাপ বহন করবে, এবং যারা সেই পদ্ধতি অনুসরণ করবে তাদের পাপও সে বহন করবে, তাতে তাদের পাপের কোন কমতি হবে না।’

অভাবগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য যে পদ্ধতি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে ওটাকে সুন্নাতে হাসানাহ বলা হয়েছে।

বলা যেতে পারে, সকল পদ্ধতি যদি হাসানাহ হয় তাহলে সুন্নাতে সাইয়্যেআহ বলতে কি বুঝাবে?

উত্তরে বলব, মনে করুন কোন দেশের শাসক বা জনগণ প্রচলন করে দিল যে এখন থেকে স্থানীয় ভাষায় আজান দেয়া হবে, আরবী ভাষায় দেয়া চলবে না। এ অনুযায়ী আ‘মাল করা শুরু হল। এটাকে আপনি কি বলবেন? বিদআত বলতে পারবেন না, কারণ যারা এ কাজটা করল তারা সকলে জানে অনারবী ভাষায় আজান দেয়া ধর্মের নির্দেশ নয় এবং এতে সওয়াবও নেই। তাই আপনি এ কাজটাকে সুন্নাতে সাইয়্যেআহ হিসাবে অভিহিত করবেন। এর প্রচলনকারী পাপের শাস্তি প্রাপ্ত হবে, আর যারা আ‘মাল করবে তারাও।

আবার অনেক ওলামায়ে কিরাম বিদআতকে অন্যভাবে দু’ভাগে ভাগ করে থাকেন। তারা বলেন বিদআত দুই প্রকার। একটা হল বিদআত ফিদ্দীন (البدعة في الدين) বা ধর্মের ভিতর বিদআত। অন্যটা হল বিদআত লিদ্দীন (البدعة للدين) অর্থাৎ ধর্মের জন্য বিদআত। প্রথমটি প্রত্যাখ্যাত আর অন্যটি গ্রহণযোগ্য।

আমার মতে এ ধরণের ভাগ নিষ্প্রয়োজন, বরং বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে সহায়ক। কারণ

প্রথমতঃ আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন সকল বিদআতই পথভ্রষ্টতা বা গোমরাহী। এতে উভয় প্রকার বিদআত শামিল।

দ্বিতীয়তঃ অনেকে বিদআত ফিদ্দীন করে বলবেন, আমি যা করেছি তা হল বিদআত লিদ্দীন। যেমন কেউ মীলাদ পড়লেন। অতঃপর যারা এর প্রতিবাদ করলেন তাদের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়ে অনেক দূর যেয়ে বললেন, মীলাদ পড়া হল বিদআত লিদ্দীন। এর দ্বারা মানুষকে ইসলামের পথে ডাকা যায়।

আসলে যা বিদআত লিদ্দীন বা দ্বীনের স্বার্থে বিদআত তা শরীয়তের পরিভাষায় বিদআতের মধ্যে গণ্য করা যায় না। সেগুলোকে সুন্নাতে হাসানাহ হিসাবে গণ্য করাটাই হাদীসে রাসূল দ্বারা সমর্থিত।

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! বিদআত সম্পর্কে এ কথাগুলো এখানে এ জন্য আলোচনা করা হল যাতে আলোচ্য বিষয়ের উপর কোন প্রশ্ন বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হলে তার সমাধান পাঠকবৃন্দ সহজে অনুধাবন করতে পারেন।

বিদআতের কুফল

এমন অনেকের সাক্ষাত পাবেন যারা ইসলামী চেতনায় সমৃদ্ধ। কিন্তু বলেন, বিদআতের বিরোধিতায় এত বাড়াবাড়ির কি দরকার? কেউ একটু মীলাদ পড়লে, কুলখানি বা চল্লিশা-চেহলাম পালন কিংবা এ জাতীয় কিছু করলে দ্বীন ইসলামের কি এমন ক্ষতি হয়ে যায়?

আমি একদিন এক মসজিদের ইমাম সাহেবের বক্তব্য শুনছিলাম। তিনি বলছিলেন শবে মিরাজ উপলক্ষ্যে এ রাতে কোন বিশেষ স্বলাত, ইবাদাত-বন্দেগী বা সিয়াম নেই। যদি শবে মিরাজ উপলক্ষ্যে কোন আ‘মাল করা হয় তা বিদআত হিসাবেই গণ্য হবে।

তার এ বক্তব্য শেষ হতে না হতেই কয়েকজন শিক্ষিত শ্রেণীর মুসল্লী বলে উঠলেন, হুজুর এ কি বলেন! রাসূল (ﷺ)-এর মুহাব্বতে এ রাতে কিছু করলে বিদআত হবে কেন? প্রশ্নকারী লোকগুলো যে বিভ্রান্ত বা বিদআতপন্থী তা কিন্তু নয়। তাদের খারাপ কোন উদ্দেশ্যও ছিল না। কিন্তু তারা যা করার ইচ্ছা করেছেন, তার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই।

অবশ্যই রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর মুহব্বত ঈমানের অঙ্গ। আর সব ধরনের মুহাব্বতেই আবেগ থাকে। রাসূল (ﷺ)-এর মুহব্বতেও থাকবে। কিন্তু সেই আবেগ যেন মুহব্বতের নীতিমালা লংঘন না করে। সেই আবেগভরা মুহাব্বত যেন আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর আদর্শ ও সুন্নাহর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয়। যদি এমনটি হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর মুহাব্বতের নামে শয়তান তাকে ধোঁকায় ফেলেছে।

এ কথাতো মুসলিমদের কাছে দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, খৃষ্টানরা বিদআতী কাজ-কর্ম করে ও তাদের নবীর মুহব্বতে বাড়াবাড়ি করে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। এ কথা যেমন পবিত্র কুরআনে এসেছে, তেমনি হাদীসেও আলোচনা করা হয়েছে।

আমি এখানে অতি সংক্ষেপে বিদআতের কতিপয় পরিণাম সম্পর্কে আলোচনা করছি যার অধিকাংশ شرح رياض الصالحين من كلام سيد المرسلين للشيخ محمد بن صالح العثيمين- رحمه الله নামক কিতাব থেকে নেয়া হয়েছে।

(১) বিদআত মানুষকে পথভ্রষ্ট করে

নবী কারীম (ﷺ) যা উম্মতের জন্য নিয়ে এসেছেন তা হল হক। এ ছাড়া যা কিছু ধর্মীয় আচার হিসাবে পালিত হবে তা পথভ্রষ্টতা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :

অর্থ : হক আসার পর বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কি থাকে ? (সূরা ইউনুস: ৩২)

রাসূলে কারীম (ﷺ) বলেছেন : كل بدعة ضلالة

অর্থ : সকল ধরনের বিদআত পথভ্রষ্টতা। (মুসলিম, ইবনে মাজাহ)

(২) বিদআত রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্য থেকে মানুষকে বের করে দেয় এবং সুন্নাতের বিলুপ্তি ঘটায়।

কেননা বিদআত অনুযায়ী কেউ আ‘মাল করলে অবশ্যই সে এক বা একাধিক সুন্নাত পরিত্যাগ করে। উলামায়ে কিরাম বলেছেন : “যখন কোন দল সমাজে একটা বিদআতের প্রচলন করে, তখন সমাজ থেকে কম করে হলেও একটি সুন্নাত বিলুপ্ত হয়ে যায়।”

আর এটা অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত যে, যখনই কোন বিদআত আমলে আনা হয়েছে তখনই সেই স্থান থেকে একটি সুন্নাত চলে গেছে বা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে মুজাদ্দিদ আলফেসানীর মাকতুবাত থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যায়। তিনি লিখেছেন : এক ব্যক্তি আমাকে প্রশ্ন করল আপনারা বলেছেন যে, কোন বিদআত নাকি একটি সুন্নাতকে বিলুপ্ত করে দেয়। আচ্ছা, যদি মৃত ব্যক্তিকে কাফনের সাথে একটি পাগড়ী পড়িয়ে দেয়া হয় তাহলে কোন সুন্নাতটি বিলুপ্ত হয়? কি কারণে এটা বিদআত বলা হবে?’

আমি জবাবে লিখলাম : অবশ্যই একটি সুন্নাত বিলুপ্ত হয় যদি মৃতের কাফনে পাগড়ী দেয়া হয়। কারণ পুরুষের কাফনের সুন্নাত হল কাপড়ের সংখ্যা হবে তিন। পাগড়ী পড়ালে এ সংখ্যা আর তিন’ থাকে না, সংখ্যা হয়ে যায় চার।’

উদাহরণ হিসাবে আরো বলা যায়, এক ব্যক্তি ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ল। ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এ সমস্যার জন্য এক পীর সাহেবের কাছে গেল। পীর সাহেব তাকে বললেন, তুমি এক খতম কুরআন বখশে দাও অথবা নির্দেশ দিলেন একটা মীলাদ দাও বা খতমে ইউনুসের ব্যবস্থা কর। সে তা-ই করল। ফলাফল কি দাড়াল? ঋণ পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তির জন্য একটি দুআ রয়েছে যা আ‘মাল করা সুন্নাত। বিদআত অনুযায়ী আ‘মাল করার কারণে সে সেই সুন্নাতটি পরিত্যাগ করল। জানার চেষ্টা করল না যে, এ ক্ষেত্রে রাসূল (ﷺ) কি ব্যবস্থা দিয়ে গেছেন। অন্যদিকে সে মিলাদ, কুরআন খতম ইত্যাদি বিদআতী কাজ করে আরও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হলো।

রমজানের শেষ দশ দিনের রাতসমূহে রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত, যা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু ১৫ শাবানে রাত জাগাকে যেমন গুরুত্ব দেয়া হয়, তেমনিভাবে এ সুন্নাতী আমলের প্রচলন দেখা যায় না। বরং শবে কদরের মূল্যায়ন দিয়ে দেয়া হচ্ছে শবে বরাতকে।

ফরয স্বলাত আদায়ের পর সর্বদা নিয়মিতভাবে জামাতবদ্ধ হয়ে মুনাজাত করা একটি বিদআত। এটা আ‘মাল করার কারণে ফরয স্বলাত আদায়ের পর যে সকল যিক্ র-আযকার সুন্নাত হিসাবে বর্ণিত আছে তা পরিত্যাগ করা হয়।

আপনি দেখবেন এভাবে প্রতিটি বিদআত একটি সুন্নাতকে অপসারিত করে তার স্থান দখল করে নেয়।

(৩) বিদআত আল্লাহর দ্বীনকে বিকৃত করে।

এর জ্বলন্ত উদাহরণ আজকের খৃষ্টান ধর্ম। তারা ধর্মে বিদআতের প্রচলন করতে করতে তার মূল কাঠামো পরিবর্তন করে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে পথভ্রষ্ট হিসাবে অভিহিত হয়েছে। তাদের বিদআত প্রচলনের কথা আল-কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে :

অর্থ : আর সন্ন্যাসবাদ! এটাতো তারা নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় প্রচলন করেছিল। আমি তাদের এ বিধান দেইনি। (সূরা হাদীদ: ২৭)

সন্ন্যাসবাদ তথা বৈরাগ্যবাদের বিদআত খৃষ্টানেরা তাদের ধর্মে প্রবর্তন করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ভাল ছিল; উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি। কিন্তু ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামত যে কোন কাজ করলেই তা গ্রহণযোগ্য হয় না। এ জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর অনুমোদন প্রয়োজন। এভাবে যারা ধর্মে বিদআতের প্রচলন করে তাদের অনেকেরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভাল থাকে। কিন্তু তাতে নাজাত পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। ইয়াহুদী ও খৃষ্টানেরা তাদের ধর্মে অন্য জাতির রসম-রেওয়াজ ও বিদআত প্রচলন করে ধর্মকে এমন বিকৃত করেছে যে, তাদের নবীগণ যদি আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন তাহলে তাদের রেখে যাওয়া ধর্ম তাঁরা নিজেরাই চিনতে পারবেন না।

এমনিভাবে আমাদের মুসলিম সমাজে শিয়া সম্প্রদায় বিদআতের প্রচলন করে দ্বীন ইসলামকে কিভাবে বিকৃত করেছে তা নতুন করে বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই।

(৪) বিদআত ইসলামের উপর একটি আঘাত।

যে ইসলামে কোন বিদআতের প্রচলন করল সে মূলতঃ অজ্ঞ লোকদের মত এ কথা স্বীকার করে নিল যে, ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন বিধান নয়, তাতে সংযোজনের প্রয়োজন আছে। যদিও সে মুখে এ ধরনের বক্তব্য দেয় না, কিন্তু তার কাজ এ কথার স্বাক্ষী দেয়। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন : আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। (সূরা মায়িদা, আয়াত : ৩)

(৫) বিদআত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে খিয়ানাতের এক ধরনের অভিযোগ।

যে ব্যক্তি কোন বিদআতের প্রচলন করল বা আ‘মাল করল আপনি তাকে জিজ্ঞেস করুন ‘এ কথা বা কাজটি যে ইসলাম ধর্মে পছন্দের বিষয় এটা কি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানতেন?’ তিনি উত্তরে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ বলবেন। যদি ‘না’ বলেন, তাহলে তিনি স্বীকার করে নিলেন যে, ইসলাম সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কম জানতেন। আর যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন, তাহলে তিনি স্বীকার করে নিলেন যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বিষয়টি জানতেন, কিন্তু উম্মাতের মধ্যে প্রচার করেননি। এ অবস্থায় তিনি তাবলীগে শিথিলতা করেছেন। খিয়ানত করেছেন আমানতের ব্যাপারে। (নাউযুবিল্লাহ!)

(৬) বিদআত মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করে ও ঐক্য-সংহতিতে আঘাত হানে

বিদআত মুসলিম উম্মাহর মধ্যে শত্রুতা ও বিবাদ-বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে তাদের মারামারি হানাহানিতে লিপ্ত করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, একদল লোক মীলাদুন্নবী পালন করল। আরেক দল বিদআত হওয়ায় তা বর্জন ও বিরোধিতা করল। যারা এটা পালন করল তারা প্রচার করতে লাগল যে, অমুক দল আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর জন্মদিনে আনন্দিত হওয়া পছন্দ করে না। তাঁর গুণ-গান করা তাদের কাছে ভাল লাগে না। তাদের অন্তরে রাসূল (ﷺ)-এর মুহাব্বত নেই। যাদের অন্তরে রাসূল (ﷺ)-এর মুহাব্বত নেই তারা বেঈমান। তারা রাসূল (ﷺ)-এর দুশমন। আর এ ধরনের প্রচারনায় তারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে একে অপরের দুশমনে পরিণত হয়ে হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ল।

এভাবে ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই বিদআতকে গ্রহণ ও বর্জনের প্রশ্নে মুসলিম উম্মাহ শিয়া ও সুন্নী এবং পরবর্তী কালে আরো শত দলে বিভক্ত হয়ে গেল। কত প্রাণহানির ঘটনা ঘটল, রক্তপাত হল।

তাই মুসলিম উম্মাহকে আবার একত্র করতে হলে সকলকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে আহ্বান ও বিদআত বর্জনের জন্য অহিংস ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় পরম ধৈর্যের সাথে আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলন করতে হবে সকল মানুষ ও মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা প্রদর্শন করে। কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন আচরণ করা যাবে না। এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, যা হক ও সত্য তা-ই শুধু টিকে থাকবে। আর যা বাতিল তা দেরীতে হলেও বিলুপ্ত হবে।

(৭) বিদআত ‘আমলকারীর তাওবা করার সুযোগ হয় না।

বিদআত যিনি প্রচলন করেন বা সেই অনুযায়ী আ‘মাল করেন তিনি এটাকে এক মহ কাজ বলে মনে করেন। তিনি মনে করেন এ কাজে আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হবেন। যেমন আল্লাহ খৃষ্টানদের সম্পর্কে বলেছেন তারা ধর্মে বৈরাগ্যবাদের বিদআত চালু করেছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে। যেহেতু বিদআতে লিপ্ত ব্যক্তি বিদআতকে পাপের কাজ মনে করেন না, তাই তিনি এ কাজ থেকে তাওবা করার প্রয়োজন মনে করেন না এবং তাওবা করার সুযোগও হয় না। অন্যান্য পাপের বেলায় কমপক্ষে যিনি পাপে লিপ্ত হন তিনি এটাকে অন্যায় মনে করেই করেন। পরবর্তীতে তার অনুশোচনা আসে, এক সময় তাওবা করে আল্লাহ তাআলার ক্ষমা লাভ করেন। কিন্তু বিদআতে লিপ্ত ব্যক্তির এ অবস্থা কখনো হয় না।

(৮) বিদআত প্রচলনকারী রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর শাফাআত পাবে না।

রাহমাতুল্লিল আলামীন (ﷺ) তাঁর গুনাহগার উম্মাতের শাফায়াতের ব্যাপারে হাশরের ময়দানে খুব আগ্রহী হবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে অনুমতি লাভ করার পর তিনি বহু গুনাহগার বান্দা-যাদের জন্য শাফাআত করতে আল্লাহ তাআলা অনুমতি দেবেন-তাদের জন্য শাফাআত করবেন। কিন্তু বিদআত প্রচলনকারীর জন্য তিনি শাফাআত করবেন না।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন :

ألا وإني فرطكم على الحوض وأكاثر بكم الأمم فلا تسودوا وجهي، ألا وإني مستنقذ أناسا ومستنقذ مني أناس، فاقول يا رب أصيحابي! فيقول إنك لا تدري ما أحدثوا بعدك. (رواه ابن ماجه، وصححه الألباني في صحيح سنن ابن ماجه)

অর্থ : শুনে রাখ! হাউজে কাউছারের কাছে তোমাদের সাথে আমার দেখা হবে। তোমাদের সংখ্যার আধিক্য নিয়ে আমি গর্ব করব। সেই দিন তোমরা আমার চেহারা মলিন করে দিওনা। জেনে রেখ! আমি সেদিন অনেক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালাব। কিন্তু তাদের অনেককে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হবে। আমি বলব : হে আমার প্রতিপালক! তারা তো আমার প্রিয় সাথী-সংগী, আমার অনুসারী। (কেন তাদের দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে ?) তিনি উত্তর দেবেন, আপনি জানেন না, আপনার চলে আসার পর তারা ধর্মের মধ্যে কি কি নতুন বিষয় আবিষ্কার করেছে। (ইবনে মাজাহ)

অন্য এক বর্ণনায় আছে এর পর আল্লাহর রাসূল (ﷺ) নিজেই তাদের উদ্দেশে বলবেন : দূর হও! দূর হও!!

(৯) বিদআত মুসলিম সমাজে কুরআন ও হাদীসের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়।

কুরআন ও সুন্নাহ হল মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামের রক্ষা কবচ। ইসলাম ধর্মের অস্তিত্বের একমাত্র উপাদান। তাইতো বিদায় হজেও নবী কারীম (ﷺ) বলেছেন : আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যতক্ষণ তোমরা তা আঁকড়ে রাখবে ততক্ষণ বিভ্রান্ত হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তার রাসূলের সুন্নাত।

বিদআত অনুযায়ী আ‘মাল করলে কুরআন ও সুন্নাহর মর্যাদা মানুষের অন্তর থেকে কমে যায়। ‘যে কোন নেক আ‘মাল কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে’ – এ অনুভূতি মানুষের অন্তর থেকে ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। তারা কুরআন ও হাদীসের উদ্ধৃতি বাদ দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি, পীর-মাশায়েখ ও ইমামদের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে।

(১০) বিদআত প্রচলনকারী অহংকারের দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে ও নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে দ্বীনকে ব্যবহার ও বিকৃত করতে চেষ্টা করে।

বিদআত প্রচলনকারী তার নিজ দলের একটি আলাদা কাঠামো দাঁড় করিয়ে ব্যবসায়িক বা আর্থিক সুবিধা লাভের জন্য এমন কাজের প্রচলন করে থাকে যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় রূপ লাভ করলেও কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত হয় না। কারণ সেই কাজটা যদি কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত হয় তাহলে তার দলের আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য থাকে না। কেননা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত আ‘মাল সকল মুসলিমের জন্যই প্রযোজ্য। তাই সে এমন কিছু আবিষ্কার করতে চায় যার মাধ্যমে তার দলের আলাদা পরিচয় প্রতিষ্ঠা করা যায়।

এ অবস্থায় যখন হাক্কানী উলামায়ে কিরাম এর প্রতিবাদ করেন বা এ কাজটি চ্যালেঞ্জ করেন তখন তার ঔদ্ধত্য বেড়ে যায়। নিজেকে সে কুতুবুল আলম, ইমাম-সম্রাট, হাদীয়ে উম্মাত, রাহবারে মিল্লাত, যিল্লুর রহমান বলে দাবী করতে থাকে। প্রচার করতে থাকে এ দুনিয়ায় সে’ই একমাত্র হক পথে আছে, বাকী সবাই ভ্রান্ত।

তাই প্রিয় পাঠকবৃন্দ, সব কাজে সকল ক্ষেত্রে আমাদের একমাত্র অবলম্বন হতে হবে আল কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহ। তাতেই মুক্তি এবং তাতেই প্রশান্তি। তাই সর্বতোভাবে বিদআত থেকে সতর্ক থাকতে হবে। পরিত্যাগ করতে হবে কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী সকল আচার-প্রচলন। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন।

সমাপ্ত