তারুণ্যের উদ্ভাবনীশক্তি ধ্বংসে পৌত্তলিক কু-সংস্কৃতি ও নারী!

তারুণ্যের উদ্ভাবনীশক্তি ধ্বংসে পৌত্তলিক কু-সংস্কৃতি ও নারী!

ইতিহাস ও জীবচালিতের দিকনির্দেশনামূলক গ্রন্থরাজির খোলাপাতার সবচেয়ে উজ্জ্বল, সর্বাধিক আলোচিত ও সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যৌবন ও তারুণ্যের শক্তি। বস্তুত সময়ের কয়েকটি সমষ্টি নিয়ে মানুষের জীবন। দিন গত হয় আর মানুষের জীবনবৃক্ষ থেকে একেকটি করে পাতা খসে পড়ে। প্রতিটি বস্তুর একটি মোক্ষম সময় থাকে এবং ওই সময়ে ওই বস্তুর সৃষ্টিস্বার্থকতা নিহিত থাকে। বৃক্ষ জন্ম নিয়েই ফল দেওয়া শুরু করে না এবং একেবারে বুড়ো হয়ে যাওয়ার পরও ফল দেয় না। বরং ফল দেয়ার একটা মোক্ষম ও উপযুক্ত সময় থাকে; যেটাকে বলে বৃক্ষের যৌবনকাল। এভাবে খুঁজে খুঁজে প্রতিটি বস্তুর সেরাকাল পাওয়া যায়। তেমনি সৃষ্টির সেরা মানবজাতিরও সময়ের সেরা একটি অংশ আছে। সময়ের ওই অংশটাই তার ইহকালীন ও পরকালীন সুখ-বিলাস ও জন্মের স্বার্থকতার মূল স্তম্ভ। মানুষের জীবনের সেই সেরাকালটা হচ্ছে যৌবনকাল।

এই সময়ের সদ্ব্যবহার মানুষকে দুনিয়া ও পরকালীন সফলতার সর্বোচ্চ চূড়ায় নিয়ে যেতে সক্ষম।

পক্ষান্তরে এর অপব্যবহার মানবজীবনকে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন করতে পারে, যে ক্ষতির কোনো কাজা-কাফফারা নেই। তাই সময়ের গুরুত্ব শুধু আখেরাতের বিচারেই নয়; দুনিয়ার বিচারেও। পার্থিব সাফল্য পেতে হলেও অবশ্যই মানুষকে সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করতে হয় সময়কে। যারা পার্থিব সাফল্য পেয়েছেন তারাও সময়ের মূল্যায়নের কারণেই তা পেয়েছেন। উদাস, কর্মস্পৃহাহীন এবং অপরিকল্পিত জীবনধারণকারী তরুণ ও যুবক স্মরণীয় কোনো সাফল্য পেয়েছে বলে ইতিহাস স্বীকার করে না। আর পারলৌকিক জীবনের সাফল্যের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে যৌবন ও তারুণ্যের উদ্যোমীশক্তির যথার্থ ও সঠিক ব্যবহার। সঙ্গত কারণেই হাদীসের বহু স্থানে তরুণ ও যৌবনকালের কথা বলা হয়েছে এবং এর সদ্ব্যবহারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
যৌবনকালে নিয়মিত নেক আমল করলে বার্ধক্যের অক্ষমতায় যখন আমল করার সক্ষমতা থাকবে না তখনও আমল লিপিবদ্ধ হওয়ার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকবে। পার্থিব জীবনেও আমরা এর বাস্তব ও চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করে থাকি। সরকারের একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করলেও তার যৌবনকাল ও সক্ষমতার সময় তার সেবার মূল্যায়ন করে নিয়মিত ভাতা প্রদান করা হয়। তাই নিঃসন্দেহে একথা বলা যায়, যৌবন ও তারুণ্যের এই সময়টাই মানবজীবনের উন্নতি-অগ্রগতির সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়েই তরুণ ও যুবকদেরকে সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করতে হবে। আর তা না করলে এবং যৌবন ও তারুণ্যের উদ্যমশক্তির অপব্যবহার করলে সাফল্যের সম্ভাবনা থেকে ছিটকে ব্যর্থতার তিমিরসম আঁধারে হারিয়ে যেতে পারে।

তারুণ্যের এই সময়টা এত গুরুত্বপূর্ণ বলেই এত স্পর্শকাতরও বটে। সাগরের উন্মাতাল ঝড়ের মতোই এর স্পর্ধা ও উন্মত্ততা। নাজুকস্পর্শ ও ব্যবহারের নূন্যতম গাফলতিতে মূল্যবান এই সম্পদ ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। ঝড়কবলিত মাস্তুল শক্তহাতে ধারণ ও পরিচালনা করতে না পারলে মধ্যসাগরে ডুবে যেতে পারে ‘তারুণ্যবাহী’ যাত্রী। আরবরা বলতেন, ‘যৌবন ও তারুণ্য হচ্ছে পাগলামির একটা শাখা।’

ইতিহাসে আমরা যাদেরকে দিগ্বিজয়ী, কীর্তিমান ও সার্বিক সাফল্যের উপমা বলে জানি, তাঁদের সাফল্যের সিঁড়ি ছিল যৌবনকালের সদ্ব্যবহার। তারিক বিন যিয়াদ একমাত্র তারুণ্যের উদ্যোমীশক্তির বলেই পশ্চাতে অথৈ ও রাশি রাশি পানি আর সামনে অচেনা, দুর্গম-রনাঙ্গনে শত্রুর মুখোমুখি হয়েও বাহনের জাহাজগুলো জ্বালিয়ে দেয়ার ঐতিহাসিক ও অবিশ্বাস্য দুঃসাহস দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুহাম্মাদ ইবনে কাসিম তারুণ্যের টগবগে রক্তবলেই ভারত উপমহাদেশে ইসলামী সালতানাতের মানচিত্র অঙ্কন করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই এখানকার মাটির সুগভীরে প্রোথিত হয়েছিল ইসলামের বৃক্ষরাজি। তারুণ্যের এই বিজয়গাঁথা ও বিজয় রচনার ইতিহাস বিস্তৃত, ব্যাপক ও সার্বজনীন। বিজয় ও সাফল্যের প্রতিটি রনাঙ্গনে ছড়িয়ে আছে যৌবন ও তারুণ্যের তাজাখুন, উদ্দীপ্ত উপস্থিতি। তাই প্রতিটি জাতির সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে তাদের যুবক ও তরুণ জনগোষ্ঠী।

সুতরাং যারা বুদ্ধিমান, যারা ইতিহাসের গতিপথ ও সাফল্যের চাবিকাঠি নিজেদের হাতে রাখতে চায় তারা তারুণ্যের শক্তিকে গুরুত্ব দেয় এবং সযত্নে রক্ষা করে এই সম্পদ।
আরেকটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে, কালে কালে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে নানামাত্রিক যুদ্ধ চলে এসেছে। কখনও সরাসরি কখনও বা পরোক্ষ ও স্নায়ুযুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের উৎসও বিভিন্ন রকমের। সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন যুদ্ধ হলো মতাদর্শে বিজয়ী হওয়ার যুদ্ধ। আজকের বিশ্ব পরম ক্ষুধাকাতর এক দানবে পরিণত হয়েছে। ফলে যে কোনো উপায়ে এই ক্ষুধা নিবারণের উগ্র বাসনায় লিপ্ত। আর এই উগ্রবাসনা পূরণ করতে পরিকল্পিতভাবে টার্গেটে পরিণত করা হয়েছে যৌবন ও তারুণ্যের উচ্ছলতাকে। এই কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে উদ্যম সংস্কৃতি ও অবাধ যৌনাচার। এই অস্ত্র ব্যবহার করে বিশ্বমোড়লরা অত্যন্ত কৌশল ও নিষ্ঠুর উপায়ে যৌবন ও তারুণ্যের পাগলাঘোড়ার লাগাম হাতে নিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করে তাদেরকে অন্তসারশূন্য করে ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দিচ্ছে। মনে ঢুকিয়ে দিচ্ছে পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণা, ভাবনায় ভরিয়ে দিয়েছে পরকালবিমুখতা, কানে তুলে দিয়েছে এফএমের ইয়ারফোন, চোখে মাখিয়েছে হলিউড, বলিউড, টালিউড ও ঢালিউডের অশ্লীলতার রঙ। রসনায় লাগিয়েছে নেশার তরল পদার্থ আর চিন্তায় প্রবেশ করিয়েছে অসৎ উপায়ে অর্থোপার্জনের অদম্য লিপ্সা।

পশ্চিমা-হিন্দুস্তানীর নগ্ন সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও অশ্লীলতায় আজকের তারুণ্য এক উদ্যমহীন, লাগামছাড়া ভোগসর্বস্ব চিন্তা নিয়ে বেড়ে উঠছে। এসব বস্তু তারুণ্যের মন থেকে শুধু পরকালচিন্তাই বিদায় করে দেয়নি বরং মানবকল্যাণে উৎসর্গিত হওয়ার অনুপ্রেরণাও ধ্বংস করে দিচ্ছে। একটি মুসলিম জাতির পতনের এরচেয়ে বড় কোনো কারণ থাকতে পারে না। আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এদেশের ক্ষমতালোভী শাসকদের কাপুরুষোচিত সিদ্ধান্তের কারণে তরুণরা বিশেষ করে হিন্দুস্তানী নোংরা সাংস্কৃতির আগ্রাসনে অতি সহজেই শত্রুর শিকারে পরিণত হচ্ছে। তথাকথিত জাতির কর্ণধাররা তারুণ্যের এই উচ্ছল শক্তিকে তাদের স্বার্থে হীনকাজে প্রয়োগ করছে। তাদের দিকভ্রান্তিতে সোজা পথ না দেখিয়ে বরং আরো অন্ধকার পথে নিয়ে যাচ্ছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর অভাব নেই, কিন্তু প্রকৃত চরিত্রবান ও নিখাঁদ দেশপ্রেমিকের অভাবের শেষ নেই। এই সমস্যার প্রধান কারণ, আমাদের তারুণ্যকে যথাযথ পরিচর্যা না করা এবং ধ্বংসোন্মুখ এই তারুণ্যকে হিন্দুস্তানী অশ্লীলতার থাবায় নিরস্ত্র অবস্থায় ফেলে রাখা। ফলে নিরস্ত্র ও পরকালীন ভাবনাহীন এই তারুণ্যের শৌর্যবীর্য আজ ক্ষয় হচ্ছে অশ্লীল কল্পনায়, পেপার-পত্রিকার হিন্দুস্তানী সিরিয়াল মেলানোর ভাবনায় এবং ভারতীয় নায়ক-নায়িকাদের স্ট্যাটাস পাঠ আর লাইক দেয়ার নোংরামি ধান্ধায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এফএম রেডিও, ইন্টারনেটসহ প্রযুক্তির অহর্নিশ অপব্যবহার। প্রযুক্তির এই যান্ত্রিকতা তারুণ্যের হৃদয় আঙিনাকে ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে। আজ এফএম রেডিওগুলোতে প্রচার করা হচ্ছে কলগার্ল (পতিতাদের) সরাসরি সাক্ষাৎকার। প্রেম-ভালোবাসার গল্প বলার ছলে প্রেমিক-প্রেমিকাদের শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপক প্রচার করা হচ্ছে এবং ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতির কবর রচনা করে তারুণ্যের  হৃদয় থেকে লজ্জা-শরম চিরবিদায় করে দিচ্ছে।

তারুণ্যের বড় শত্রু আজ চারটি বস্তু। মোবাইল ভিডিও, এফএম রেডিও, নেশাজাত দ্রব্য এবং তথাকথিত প্রেমভালোবাসা। প্রেম-ভালোবাসার নামে চলছে মূলত ভয়ানক ব্যভিচার এবং ধর্ষণ ও অপহরণ। বিশ্বের পণ্যের বিপুল চাহিদা সৃষ্টির জন্য এই চারটি বস্তুর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। ফলে তারা সচতুরভাবে সামাজিক অবক্ষয়ের এই ভয়ানক উপকরণগুলো তরুণ ও যুবকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে। হলফ করেই বলা যায়, হিন্দুস্তানী বণিকরা তাদের উদ্দেশ্যে সফল হয়েছে এবং তরুণরা তাদের দেওয়া অবক্ষয়ের এই দাওয়াইগুলো প্রাণসঞ্জীবিনী মনে করে দেদারছে গিলছে। এর ফলে তারা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হারিয়ে সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দুস্তান ও পাশ্চাত্যের দাসানুদাস জাতিতে পরিণত হচ্ছে। যৌবনের পাগলা ঘোড়া তাদেরকে যেদিকে টানছে তারা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সেদিকেই দৌড়াচ্ছে। অবক্ষয় তাদেরকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, এর কারণে তারা স্বাধীন-সংস্কৃতি ও স্বকীয় তাহযীব-তামাদ্দুনের মূল্যায়ন করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে। হতোদ্যম এই তারুণ্য হিন্দুস্তানী গানবাজনায় বিভোর। তাই তারা নিজ দেশের গান ও বিজয়ের নিশান ওড়ানোর সাহস দেখাতে পারছে না।

সুতরাং তারুণ্যের এই উদ্ভাবনীশক্তি ধরে রাখতে হলে অবশ্যই ইহুদি-খ্রিস্টান-পৌত্তলিক সংস্কৃতি ও অশ্লীলতার ছোবল থেকে তাদেরকে দূরে রাখতে হবে। বাঁচাতে হবে দেশের স্বাধীনতা। আমাদের এই মুসলিম দেশটির বিরুদ্ধে বিজাতির দাদাগিরি প্রতিহত করতে সর্বাগ্রে তাদের অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। অন্যথায় আমাদের পরিণতি হতে পারে হায়দারাবাদের মতো, যে দেশটি স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও ভারত বিভিন্ন কলাকৌশলে দখল করে নেয় এবং এভাবে পৌত্তলিকদের ষড়যন্ত্রে বিশ্বমানচিত্র থেকে হারিয়ে যায় একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের পতাকা। যে দেশের তারুণ্যের শক্তি উদ্যমহীন হয়ে পড়ে, অপসংস্কৃতির কাদা-পানিতে মিশে যায় সেই দেশের স্বাধীনতা-স্বকীয়তা রক্ষা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই শুধু পরকালের স্বার্থেই নয়, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে আমাদেরকে লড়তে হবে নিজেদের ও দেশেরই স্বার্থে।

 

>>>কৃতজ্ঞতাঃ- i-onlinemedia<<<