চেয়ারে বসে ছালাত আদায়

চেয়ারে বসে ছালাত আদায় !!!

চেয়ারে বসে ছালাত আদায়  !!!

অসুস্থ ব্যক্তির চেয়ারে বসে ছালাত আদায়ের ব্যাপারে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ফৎওয়া বোর্ড অসুস্থ ব্যক্তির জন্য চেয়ারে বসে ছালাত আদায় করাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে জাতীয় সংসদেও আলোচনা হয়েছে। অথচ দ্বীন সহজ। এতে কাঠিন্যের কোন স্থান নেই। সুতরাং ভুল ফৎওয়া দিয়ে এ জীবন ব্যবস্থাকে মানুষের কাছে কঠিন হিসাবে উপস্থাপন করার কোন যৌক্তিকতা নেই।

আল্লাহ তা‘আলা মানুষ ও জিন জাতিকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন (যারিয়াত ৫১/৫৬)। অতঃপর বান্দাকে তার সাধ্যমত ইবাদত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,    فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ  ‘তোমরা সাধ্যমত আল্লাহকে ভয় কর’ (তাগাবুন ৬৪/১৬)। তিনি বলেন, لاَ يُكَلِّفُ اللهُ نَفْساً إِلاَّ وُسْعَهَا  ‘আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৮৫)।

শরী‘আতের বিধানসমূহ বান্দাদের উপর চাপিয়ে তাদেরকে কষ্টে না ফেলে তিনি এর দ্বারা তাদেরকে পবিত্র করতে চান। তিনি বলেন,

مَا يُرِيْدُ اللهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُمْ مِنْ حَرَجٍ وَلَكِنْ يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ-

‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে কোন কষ্টের মধ্যে ফেলতে চান না। বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের উপর তাঁর নে‘মত পরিপূর্ণ করতে চান। যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর’ (মায়েদাহ ৫/৬)। তিনি আরো বলেন, يُرِيْدُ اللهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيْدُ بِكُمُ الْعُسْرَ  ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান তোমাদের জন্য যা কষ্টকর তা তিনি চান না’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)।

রাসূল (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীদের লক্ষ্য করে বলেন, يَسِّرُوْا وَلاَ تُعَسِّرُوْا، وَبَشِّرُوْا وَلاَ تُنَفِّرُوْا ‘তোমরা দ্বীনকে সহজ কর, কঠিন কর না। তাদেরকে সুসংবাদ দাও এবং (দ্বীনকে কঠিনভাবে উপস্থাপন করে তাদেরকে) তাড়িয়ে দিয়ো না’।[1] রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে দু’টি জিনিস উপস্থাপন করা হ’লে তিনি সহজটি গ্রহণ করতেন।[2]

ছালাত আদায়ের অবস্থা সমূহ :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَى وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ  ‘তোমরা ছালাতসমূহ ও মধ্যবর্তী ছালাতের হেফাযত কর এবং আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠচিত্তে দাঁড়িয়ে যাও’ (বাক্বারাহ ২/২৩৮)। এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, একজন সুস্থ মানুষ ফরয ছালাত দাঁড়িয়ে আদায় করবে। কারণ এটি ছালাতের রুকন, যা ইচ্ছাকৃত বা ভুলক্রমে পরিত্যাগ করলে ছালাত বাতিল হয়ে যাবে। বসে ছালাত আদায় করলে ছালাত হবে না। তবে নফল ছালাত বসে আদায় করাতে কোন বাধা নেই। কিন্তু বসে নফল ছালাত আদায়কারী দাঁড়িয়ে ছালাত আদায়কারীর অর্ধেক ছওয়াব পাবে।[3]

عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ رضى الله عنه  قَالَ: كَانَتْ بِىْ بَوَاسِيْرُ فَسَأَلْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم عَنِ الصَّلاَةِ فَقَالَ: صَلِّ قَائِمًا، فَإِنْ لَمْ تَسْتَطِعْ فَقَاعِدًا، فَإِنْ لَمْ تَسْتَطِعْ فَعَلَى جَنْبٍ-

ইমরান ইবনু হুছাইন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার অর্শ (পাইলস) রোগ ছিল। সেজন্য আমি রাসূল (ছাঃ)-কে ছালাত আদায়ের পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তখন তিনি বললেন, ‘তুমি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করবে, তাতে সক্ষম না হ’লে বসে এবং বসতে সক্ষম না হ’লে শুয়ে ছালাত আদায় করবে’।[4] উক্ত আয়াত ও হাদীছ থেকে ছালাত আদায়ের তিনটি অবস্থা প্রমাণিত হয়। ১. দাঁড়িয়ে ২. বসে এবং ৩. শুয়ে। অসুস্থ ব্যক্তি বসে বা শুয়ে ছালাত আদায় করলেও দাঁড়িয়ে ছালাত আদায়কারীর সমপরিমাণ ছওয়াব পাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِذَا مَرِضَ الْعَبْدُ أَوْ سَافَرَ، كُتِبَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ مَا كَانَ يَعْمَلُ مُقِيْمًا صَحِيْحًا  ‘যখন বান্দা পীড়িত অথবা সফরে থাকে, তখন সে যা আমল করে তাতে সুস্থ অবস্থায় বাড়িতে অবস্থান করে ইবাদতকারীর ন্যায় ছওয়াব পাবে।[5]

ছালাতের ২য় অবস্থা :

عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: عَادَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلًا مِنْ أَصْحَابِهِ مَرِيضًا، وَأَنَا مَعَهُ فَدَخَلَ عَلَيْهِ، وَهُوَ يُصَلِّي عَلَى عُودٍ فَوَضَعَ جَبْهَتَهُ عَلَى الْعُودِ فَأَوْمَأَ إِلَيْهِ فَطَرَحَ الْعُودَ وَأَخَذَ وِسَادَةً فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: دَعْهَا عَنْكَ إِنِ اسْتَطَعْتَ أَنْ تَسْجُدَ عَلَى الْأَرْضِ، وَإِلَّا فَأَوْمِئْ إِيمَاءً، وَاجْعَلْ سُجُودَكَ أَخْفَضَ مِنْ رُكُوعِكَ-

ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) তাঁর এক অসুস্থ ছাহাবীকে দেখতে গেলেন। এমতাবস্থায় আমি তাঁর সাথে ছিলাম। তিনি তার কাছে প্রবেশ করে দেখলেন যে, তিনি কাঠের উপর কপাল রেখে ছালাত আদায় করছেন (কাঠের উপর সিজদা করছেন)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইশারা করলে তিনি কাঠটি ছুঁড়ে ফেলে একটি বালিশ নিলেন। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, তুমি বালিশ সরিয়ে দাও এবং সাধ্যমত মাটিতে সিজদা কর। অন্যথায় ইশারা করে ছালাত আদায় কর। আর রুকূর তুলনায় সিজদায় মাথা কিছুটা বেশী নীচু করবে’।[6] জাবের (রাঃ) থেকেও অনুরূপ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[7]

عَنْ أُمِّ قَيْسٍ بِنْتِ مِحْصَنٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَمَّا أَسَنَّ وَحَمَلَ اللَّحْمَ اتَّخَذَ عَمُودًا فِى مُصَلاَّهُ يَعْتَمِدُ عَلَيْهِ.

উম্মে কায়েস বিনতে মিহছান হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) যখন বার্ধক্যে উপনীত হ’লেন এবং শরীর ভারী হয়ে গেল, তখন তিনি মুছাল্লায় একটি লাঠি রাখতেন। যার উপর ভর দিয়ে তিনি ছালাত আদায় করতেন।[8] অত্র হাদীছ দ্বারা অসুস্থতার দরুন কোন কিছুতে হেলান দিয়ে ছালাত আদায়ের বৈধতা প্রমাণিত হয়। আয়েশা (রাঃ) বলেন, أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم لَمْ يَمُتْ حَتَّى كَانَ كَثِيرٌ مِنْ صَلاَتِهِ وَهُوَ جَالِسٌ  ‘নবী করীম (ছাঃ) মৃত্যু অবধি তাঁর অধিকাংশ (নফল) ছালাত বসে আদায় করেছেন।[9] হ’লে ফরয ছালাতও বসে আদায় করেছেন।[10] রাসূল (ছাঃ) শেষ বয়সে অসুস্থ হয়ে পড়লে ফরয ছালাত বসে আদায় করতেন।[11]  নববী (রহঃ) বলেন, ‘কোন অসুস্থ ব্যক্তি বসে ছালাত আদায় করলে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায়কারীর ন্যায় ছওয়াব পাবে’।[12]

ইবনু কুদামাহ (রহঃ) বলেন,  أجمع أهل العلم على أن من لا يطيق القيام له أن يصلي جالساً-  ‘বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, দাঁড়াতে অক্ষম ব্যক্তি বসে ছালাত আদায় করবে’।[13]

ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, أجمعت الأمة على أن من عجز عن القيام في الفريضة صلاها قاعداً ولا إعادة عليه-  ‘মুসলিম উম্মাহ এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছে যে, ফরয ছালাতে  দাঁড়াতে  অক্ষম  ব্যক্তি  বসে  ছালাত আদায় করবে

এবং তাকে পুনরায় ছালাত ঘুরিয়ে পড়তে হবে না’।[14]

আল্লামা শাওকানী (রহঃ) বলেন,

وحديث عمران يدلُّ على أنَّه يجوز لمن حصل له عذر لا يستطيع معه القيام أن يصلِّي قاعدًا ولمن حصل له عذر لا يستطيع معه القعود  أن يصلِّي على جنبه-

ইমরান (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি[15] প্রমাণ করে যে, যার ওযর আছে যে, সে দাঁড়াতে সক্ষম নয়, সে বসে ছালাত আদায় করবে। আর যার ওযর থাকার কারণে বসতে সক্ষম নয়, সে শুয়ে ছালাত আদায় করবে’।[16]

শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,

وَقَدِ اتَّفَقَ الْمُسْلِمُوْنَ عَلَى أَنَّ الْمُصَلِّيَ إذَا عَجَزَ عَنْ بَعْضِ وَاجِبَاتِهَا كَالْقِيَامِ أَوْ الْقِرَاءَةِ أَوْ الرُّكُوْعِ أَوْ السُّجُوْدِ أَوْ سَتْرِ الْعَوْرَةِ أَوْ اسْتِقْبَالِ الْقِبْلَةِ أَوْ غَيْرِ ذَلِكَ سَقَطَ عَنْهُ مَا عَجَزَ عَنْهُ-

‘মুসলমানগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, মুছল্লী যখন ছালাতের কিছু ফরয যেমন কিয়াম (দাঁড়ানো), কিরাআত, রুকূ, সিজদাহ, লজ্জাস্থান আবৃত করা, কিবলামুখী হওয়া ও অন্যান্য বিধান পালনে অপারগ হবে, তখন অক্ষমতার বিষয়সমূহ তার উপর থেকে রহিত হয়ে যাবে’।[17]

বসে ছালাত আদায়ের পদ্ধতি সমূহ

প্রথম পদ্ধতি :

যে ব্যক্তি রোগ, অতিরিক্ত ওযন কিংবা অন্য কোন কারণে দাঁড়িয়ে থাকতে অক্ষম কিন্তু রুকূ-সিজদা করতে সক্ষম, এরূপ ব্যক্তি যেভাবে বসে তার পক্ষে ছালাত আদায় করা সম্ভব, সেভাবেই সে ছালাত আদায় করবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, দাঁড়াতে সক্ষম না হ’লে বসে ছালাত আদায় করবে।[18] তবে রুকূ এবং সিজদার সময় ইশারা করবে। আর রুকূর তুলনায় সিজদায় মাথা বেশী নীচু করবে। রাসূল (ছাঃ) তাঁর এক অসুস্থ ছাহাবীকে বলেন, তুমি ইশারা করে ছালাত আদায় কর। আর রুকূর তুলনায় সিজদায় মাথা বেশী নীচু করবে।[19]

দ্বিতীয় পদ্ধতি :

রোগ বা ওযন বেশী হওয়ার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়াতে অক্ষম, কিন্তু কিছু সময়ের জন্য দাঁড়াতে সক্ষম। এরূপ ব্যক্তি সাধ্যমত দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করবে। যখন তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টসাধ্য হবে তখন বসে পড়বে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ   ‘সুতরাং সাধ্যানুযায়ী

আল্লাহকে ভয় কর’ (তাগাবুন ৬৪/১৬) ।

আল্লামা আব্দুর রহমান বিন নাছির সা‘দী (রহঃ) বলেন, এ আয়াত প্রমাণ করে যে, প্রত্যেক ওয়াজিব কাজ যখন বান্দা পালনে অপারগ হবে তখন তার উপর থেকে তা রহিত হয়ে যাবে। আর যখন বান্দা কোন কাজের কিছু অংশ পালনে সক্ষম ও কিছু অংশ পালনে অক্ষম হবে, তখন সে ততটুকু পালন করবে যতটুকু পালন করা তার পক্ষে সম্ভব। আর বাকীটুকু রহিত হয়ে যাবে । যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ- ‘আমি যখন তোমাদেরকে কোন বিষয়ে নির্দেশ দেই তখন তোমরা তা পালন কর যতটুকু তোমরা সক্ষম হও’।[20]

তৃতীয় পদ্ধতি :

যে ব্যক্তি রোগ, স্থূলতা, কিংবা অন্য কোন কারণে দাঁড়াতে সক্ষম কিন্তু রুকূ করতে অক্ষম। এরূপ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করা শুরু করবে। যখন রুকূ করার সময় হবে তখন চেয়ারে বসে বা দাঁড়িয়ে তার সাধ্যমত ইশারা করে রুকূ করবে। অতঃপর সাধ্যমত মাটিতে সিজদা করবে। ইবনু কুদামাহ বলেন, যে ব্যক্তি দাঁড়াতে সক্ষম কিন্তু রুকূ-সিজদা করতে অক্ষম, তার জন্য দাঁড়ানো রহিত হবে না। সে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করবে এবং ইশারায় রুকূ করবে।[21]

চতুর্থ পদ্ধতি :

যে ব্যক্তি দাঁড়াতে সক্ষম, কিন্তু সিজদা করতে অক্ষম। এরূপ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করা শুরু করবে এবং কিয়াম ও কিরাআত পাঠ করার পর রুকূ করবে। অতঃপর সিজদার সময় সাধ্যমত চেয়ারে বা মাটিতে বসে ইশারায় সিজদা করবে। সিজদার সময় সক্ষম হ’লে সে মাটিতে হাত রাখবে। অন্যথায় হাঁটুর উপর হাত রেখে ইশারায় সিজদা করবে।

পঞ্চম পদ্ধতি :

যে ব্যক্তি ছালাতে দাঁড়াতে সক্ষম কিন্তু রোগের কারণে রুকূ ও সিজদা করতে অক্ষম। সে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করা শুরু করবে। যখন রুকূ করার সময় হবে তখন সে সাধ্যমত চেয়ারে বা মাটিতে বসে ইশারা করে রুকূ ও সিজদা করবে। অর্থাৎ ঝুঁকে রুকূ আদায় করবে, কিন্তু সিজদাতে রুকূর চেয়েও একটু বেশি ঝুঁকবে।[22]

চেয়ারে বসে ছালাত আদায়ের ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের ফাৎওয়া :

(১) শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি মাটি বা চেয়ারে বসে ছালাত আদায় করবে তার জন্য আবশ্যক হ’ল- সে রুকূর তুলনায় সিজদায় বেশী মাথা নিচু করবে। আর তার জন্য সুন্নাত হ’ল- রুকূ অবস্থায় তার দু’হাত হাঁটুতে রাখা। আর সিজদা অবস্থায় আবশ্যক হ’ল- সাধ্যমত হাত দু’টিকে মাটিতে রাখা। তাতে সক্ষম না হ’লে হাতদ্বয় হাঁটুর উপর রাখতে হবে। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আমি সাতটি অঙ্গের উপর সিজদা করতে আদিষ্ট হয়েছি- কপাল, দু’হাত, হাঁটুদ্বয় ও দু’পায়ের অগ্রভাগ।[23] আর যে ব্যক্তি এতেও অপারগ হবে এবং চেয়ারে বসে ছালাত আদায় করবে, তাতে কোন অসুবিধা নেই।[24]

(২) সঊদী আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের ফৎওয়া বোর্ড ‘লাজনা-দায়েমা’কে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হ’লে তারা উত্তরে বলেন, ‘দাঁড়াতে অক্ষম ব্যক্তি মাটিতে বা চেয়ারে বসে ছালাত আদায় করতে পারে, যদি তা তার জন্য সুবিধাজনক হয়। যখন সে মাটিতে সিজদাহ করতে অক্ষম হবে, তখন সে শূন্যে ইশারায় রুকূ-সিজদা করবে। তবে রুকূর তুলনায় সিজদায় মাথা বেশী নীচু করবে।[25] কিন্তু বালিশ বা কোন বস্ত্ততে সিজদা দিতে পারবে না।[26]

(৩) শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বলেন, অসুস্থ অবস্থায় চেয়ারে বসে ছালাত আদায়ে কোন বাধা নেই। প্রথমতঃ দাঁড়িয়ে ছালাত করতে হবে। না পারলে ছালাতে বসার ন্যায় বসে আদায় করবে। তাতে অক্ষম হ’লে চারজানু হয়ে বসে। এতেও সক্ষম না হ’লে হাতে হেলান দিয়ে বসে ছালাত আদায় করবে। আল্লাহকে সাধ্যমত ভয় করতে হবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,    فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ‘সুতরাং তোমরা সাধ্যানুযায়ী আল্লাহকে ভয় কর’ (তাগাবুন ৬৪/১৬) । তাছাড়া আল্লাহ আরও বলেন, لاَ يُكَلِّفُ اللهُ نَفْساً إِلاَّ وُسْعَهَا  ‘আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে তার সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না’।[27]

(৪) শায়খ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ বলেন, কিয়াম, কিরাআত, রুকূ ও সিজদা ছালাতের রুকনসমূহের অন্তর্ভুক্ত। যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে সে এগুলো যথাযথভাবে পালন করবে। তবে যে ব্যক্তি অসুস্থতা বা বার্ধক্যের কারণে দাঁড়াতে অক্ষম হবে, সে মাটিতে বা চেয়ারে বসে ছালাত আদায় করবে।[28]

(৫) ফাতাওয়ায়ে আযহারে বলা হয়েছে, যদি কেউ চেয়ার ব্যতীত অন্য কোথাও বসতে না পারে, তাহ’লে চেয়ারে বসে ছালাত আদায়ে কোন বাধা নেই। তবে মাথা দিয়ে ইশারা করে রুকূ-সিজদা করবে।[29]

(৬) ফাতাওয়াশ শাবাকাতুল ইসলামিইয়ায় অসুস্থ ব্যক্তির চেয়ারে বসে ছালাত আদায়ের বৈধতার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হ’লে উত্তরে বলা হয়,فلا حرج إن شاء الله في الصلاة على كرسي لمن عجز عن الصلاة قائماً، ولو كان ذلك في داخل المسجد، ‘দাঁড়িয়ে ছালাত আদায়ে অক্ষম ব্যক্তির জন্য চেয়ারে বসে ছালাত আদায়ে ইনশাআল্লাহ কোন অসুবিধা নেই। যদিও তা মসজিদের ভিতরে হয়’।[30] এছাড়াও বিভিন্ন দেশের প্রখ্যাত ওলামায়ে কেরাম অসুস্থ ব্যক্তির জন্য চেয়ারে বসে ছালাত আদায়ের পক্ষে ফৎওয়া দিয়েছেন।

চেয়ারে বসে ছালাত আদায়কালে করণীয় :

যারা চেয়ারে বসে ছালাত আদায় করবে তারা সরাসরি ইমামের পিছনে দাঁড়ানো থেকে বিরত থাকবে। তারা কাতারের শেষ প্রান্তে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে। তবে প্রত্যেক মুছল্লীর প্রথম কাতারের ছওয়াব অর্জনের অধিকার রয়েছে।[31] তাই অসুস্থ ব্যক্তি প্রথম কাতারের নেকির আশায় কাতারের ডাইন বা বাম প্রান্তে চেয়ারে বসতে পারে।

চেয়ারটি হবে ছোট আকারের। যাতে পাশের ও পিছনের অন্যান্য মুছল্লীর কাতার নষ্ট না হয় বা সোজা করতে কোন অসুবিধা না হয় (এ ব্যাপারে হারামায়েন-এর চেয়ার সমূহ দ্রষ্টব্য)। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা কাতার সোজা কর। কেননা কাতার সোজা করা ছালাতের পূর্ণতার অংশ’।[32] চেয়ারের পায়া পাশের মুছল্লীর পায়ের সাথে মিলে থাকতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা কাতার সোজা কর এবং একে অপরের সাথে ঘেঁষে ঘেঁষে দাঁড়াও। কারণ আমি তোমাদেরকে পিছন থেকেও দেখতে পাই’।[33] তিনি ছালাতে কাঁধে কাঁধ ও পায়ের সাথে পা মিলিয়ে দাঁড়াতে বলতেন।[34] তিনি আরো বলতেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতামন্ডলী কাতারে ঘেঁষে ঘেঁষে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন’।[35] রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, ‘তোমরা শয়তানের জন্য কাতারের মাঝে ফাঁকা স্থান রেখো না। যে কাতারের সাথে মিলে দাঁড়াল আল্লাহ তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করলেন। আর যে কাতার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকল আল্লাহ তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন’।[36] রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাতারে দু’জনের মাঝের ফাঁকা বন্ধ করল, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতে গৃহ নির্মাণ করবেন এবং তার মর্যাদা এক গুণ বৃদ্ধি করবেন’।[37]

শায়খ ওছায়মীন ও আব্দুর রহমান বার্রাক (রহঃ) বলেন, যদি মুছল্লী পুরো ছালাত চেয়ারে বসে আদায় করে তাহ’লে চেয়ারের পায়া মুছল্লীদের পায়ের বরাবর রাখতে হবে। আর যদি কেবল রুকূ ও সিজদার সময় চেয়ার ব্যবহার করা হয়, তাহ’লে সে কাতারের সাথে মিলে দাঁড়াবে এবং চেয়ার পিছনে রাখবে। তবে এমন পিছনে রাখা যাবে না যাতে পিছনের মুছল্লীর রুকূ-সিজদা করতে কষ্ট হয়।[38]

অতএব একজন সুস্থ ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করতে হবে। তাতে সক্ষম না হ’লে মাটিতে বসে ছালাত আদায় করতে হবে। তাতে সক্ষম না হ’লে চেয়ার বা অনুরূপ সহায়ক বস্ত্ততে বসে ছালাত আদায় করতে হবে। তাতে সক্ষম না হ’লে শুয়ে যেভাবে সম্ভব হবে সেভাবে ছালাত আদায় করতে হবে। ব্যক্তির জ্ঞান থাকা পর্যন্ত ছালাত মাফ নেই। প্রত্যেক মুসলমানকে ছালাতের ব্যাপারে আরো যত্নবান হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ বুঝে সে অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দিন-আমীন!

[1]. বুখারী হা/৬৯; মুসলিম হা/১৭৩৪।

[2]. বুখারী হা/৩৫৬০; মিশকাত হা/৫৮১৭।

[3]. বুখারী হা/১১১৫; মিশকাত হা/১২৪৯।

[4]. বুখারী হা/১১১৭; মিশকাত হা/১২৪৮।

[5]. বুখারী হা/২৯৯৬; আহমাদ হা/১৯৬৯৪; মিশকাত হা/১৫৪৪।

[6]. মু‘জামুল কাবীর হা/১৩০৮২; ছহীহাহ হা/৩২৩।

[7]. বায়হাকী, সুনানুল কুবরা হা/৩৪৮৪; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/২৮৯৪।

[8]. আবুদাঊদ হা/৯৪৮; ছহীহাহ হা/৩১৯; ইরওয়া হা/৩৮১।

[9]. মুসলিম হা/৭৩২; নাসাঈ হা/১৬৫৬।

[10]. বুখারী হা/১১১৪; মুসলিম হা/৪১১; মিশকাত হা/১১৩৯।

[11]. নাসাঈ হা/৭৯৭; আহমাদ হা/২৬১৫৬।

[12]. আল-মাজমূ‘ ৪/৩১০।

[13]. মুগনী ২/১০৬।

[14]. মাজমূ‘ ৪/৩১০; ছালেহ মুনাজ্জিদ, ফাতাওয়া ইসলাম ১/৫০০৯, প্রশ্ন নং ৫০৬৮৪।

[15]. বুখারী হা/১১১৭।

[16]. নায়লুল আওত্বার ৩/২২৫; ফাতাওয়া ইয়াসআলূনাকা ৮/১৫।

[17]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৮/৪৩৮।

[18]. বুখারী হা/১১১৭; মিশকাত হা/১২৪৮।

[19]. মু‘জামুল কাবীর হা/১৩০৮২; ছহীহাহ হা/৩২৩।

[20]. বুখারী হা/৭২৮৮; মিশকাত হা/২৫০৫; তাফসীরে সা‘দী, পৃঃ ১০৩১।

[21]. মুগনী ২/১০৭।

[22]. মু‘জামুল কাবীর হা/১৩০৮২; ছহীহাহ হা/৩২৩।

[23]. বুখারী হা/৮১২; মিশকাত হা/৮৮৭।

[24]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া বিন বায ১২/২৪৫-২৪৬; ফাতাওয়া ইসলাম ১/৫০০৯, প্রশ্ন নং ৫০৬৮৪।

[25]. মু‘জামুল কাবীর হা/১৩০৮২; ছহীহাহ হা/৩২৩।

[26]. ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৬/৩৬০, ৬/৩৬৭, প্রশ্ন নং ১৮৫৩৬, ১৭২৮২।

[27]. বাক্বারাহ ০২/২৮৫; ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ৩/১৮৪, ৫/১৮৪।

[28]. ছালেহ মুনাজ্জিদ, ফাতাওয়া ইসলাম ১/৫০০৯, প্রশ্ন নং ৫০৬৮৪।

[29]. ফাতাওয়া আযহার ১/৬০; ফাতাওয়া দারিল ইফতা আল-মিসরিইয়াহ ১/৬০।

[30]. আব্দুল্লাহ ফকীহ, ফাতাওয়াশ শাবকাতুল ইসলামিইয়া ৪/২৩৪৫, প্রশ্ন নং ২২২৯১।

[31]. বুখারী হা/৭২১; মিশকাত হা/৬২৮।

[32]. বুখারী হা/৭২৩; মুসলিম হা/৪৩৩; মিশকাত হা/১০৮৭।

[33]. বুখারী হা/৭১৯; মিশকাত হা/১০৮৬।

[34]. আবুদাউদ হা/৬৬৭; মিশকাত হা/১০৯৩।

[35]. ইবনু মাজাহ হা/৯৯৫; ছহীহাহ হা/২২৩৮,২৫৩২; ছহীহুল জামে‘ হা/১৮৩৪।

[36]. আবুদাউদ হা/৬৬৬; মিশকাত হা/১১০২; ছহীহাহ হা/৭৪৩।

[37]. মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৫৭৯৭; ছহীহাহ হা/১৮৯২।

[38]. ফাতাওয়া ইসলাম ১/৬৫৪০, ১/৫০০৯, প্রশ্ন নং ৯২০৯ ও ৫০৬৮৪: আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ ৬/২১।

আব্দুর রহীম

{{{সৌজন্যেঃ- সত্যের দিকে আহবান Website}}}