ঈমান কি?

উত্তরঃ আরবী ‘আমন’ শব্দ থেকে ঈমান শব্দটির উৎপত্তি। আমন অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, আস্থা, বিশ্বস্ততা, হৃদয়ের স্থিতি ইত্যাদি। ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থঃ নিরাপত্তা প্রদান, আস্থা স্থাপন, বিশ্বাস ইত্যাদি। শব্দটির অর্থ সম্পর্কে ৪র্থ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ আবুল হুসাইন আহমাদ ইবনুল ফারিস (৩৯৫ হিজরী) বলেনঃ “হামযা, মীম ও নুনঃ এই ধাতুটির মূল অর্থ দুটিঃ

প্রথম অর্থঃ বিশস্ততা, যা খিয়ানতের বিপরীত এবং দ্বিতীয় অর্থ বিশ্বাস করা বা কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের সত্যতা স্বীকার করা। আমরা দেখছি যে, অর্থ দুটি খুবই নিকটবর্তী ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। [1]

বিশ্বাস বা ধর্ম বিশ্বাস অর্থে কোরআন ও হাদীসে সর্বদা ‘ঈমান’ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে। কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ

وَمَن يَكْفُرْ بِالْإِيمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ

“আর কেউ ঈমান প্রত্যাখ্যান করলে তার কর্ম বিনষ্ট বা নিস্ফল হবে এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”[2]

অন্যত্র তিনি বলেছেনঃ

إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا

“যথন তার (আল্লাহর) আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে।”[3]

ইসলামি পরিভাষায় ঈমান হলোঃ অন্তরে বিশ্বাস করা, জবান দ্বারা স্বীকৃতি দেওয়া এবং সে মোতাবেক কাজে বাস্তবায়ন করা, যা সৎ আমলের দ্বারা বাড়ে এবং পাপ কাজের দ্বারা কমে।

ঈমানের রোকন ৬টি, যথাঃ আল্লাহ, তার ফেরেশতাগন বা মালাকগন, আসমানী কিতাবসমূহ, রাসুলগন, শেষ দিবস এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান আনা।

এক হাদীসে আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেনঃ “একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকজনের মধ্যে ছিলেন। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি (ফেরেশতা জিবরাঈল) তার নিকট আগমন করে বলেন, ঈমান কি? তিনি উত্তরে বলেনঃ (ঈমান এই যে,) তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহয়, তার ফেরেশতাগনে, তার কিতাবসমূহে, তার সাক্ষাতে, তার রাসুলগনে এবং তুমি বিশ্বাস করবে শেষ পুনরুন্থানে এবং তুমি বিশ্বাস করবে তাকদীর বা নির্ধারণের সবকিছুতে।…”[4]

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ)বলেছেনঃ “দ্বীন ও ঈমান কথা ও কাজের নাম। অন্তর ও জবানের কথাকে, অন্তর, জবান ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলকে দ্বীন ও ঈমান বলা হয়। আর নিঃসন্দেহে ঈমান সৎ কাজ করলে বাড়ে এবং গুনাহের কাজ করলে কমে যায়।”[5]

ইমাম আনাস ইবন মালিক, ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইদরীস আশ-শাফিয়ী, ইমামুল আহলুস সুন্নাহ ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) ও মুহাদ্দিসগন বলেন যে, আমল বা কর্ম ঈমানের অংশ, তবে মনের বিশ্বাস বা মুখের স্বীকৃতির মত অংশ নয়, বরং দ্বিতীয় পর্যায়ের অংশ।

এজন্য তাদের মতে কর্মের অনুপস্থিতি দ্বারা ঈমানের অনুপস্থিতি প্রমানিত হয় না, তবে দুর্বলতা ও কমতি প্রমানিত হয়। তারা বলেন ঈমান হলো অন্তরের বিশ্বাস, মুখের স্বীকৃতি ও দেহের কর্ম।

এদের মতে কর্মের কারনে ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি হয়।[6]

ইমাম আবু হানীফা নু’মান ইবনু ছাবিত (রাহিমাহুল্লাহ) ও অন্যান্য কোনো কোনো ইমামের মতে আমল বা বিধান পালন ঈমানের অংশ নয়, বরং ঈমানের ঈমানের দাবি ও সম্পূরক। তাদের মতে ঈমান হলো অন্তরের বিশ্বাস ও মুখে সে বিশ্বাসের স্বীকৃতির নাম। তাদের মতে বিষয়বস্তুর দিক থেকে স্বীকৃতি বেশি কম হয় না বা ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না, তবে বিশ্বাসের গভীরতার দিক দিয়ে হ্রাস-বৃদ্ধি হয়।[7]

শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ), তিনি সৌদি আরবের ফাতওয়া বোর্ডের অন্যতম প্রসিদ্ধ আলীম ছিলেন। তিনি বলেছেনঃ “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে ঈমানের অর্থ হল অন্তরের বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকারোক্তি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল- এই তিনটি বিষয়ের সমষ্টির নাম ঈমান। যেহেতু উক্ত বিষয় সমূহের সমষ্টির নাম ঈমান সে হিসাবে, তা (ঈমান) বাড়বে এবং কমবে এটিই স্বাভাবিক।… ঈমানের বেশী-কম হওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট দলীল-প্রমান রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

وَمَا جَعَلْنَا أَصْحَابَ النَّارِ إِلَّا مَلَائِكَةً ۙ وَمَا جَعَلْنَا عِدَّتَهُمْ إِلَّا فِتْنَةً لِّلَّذِينَ كَفَرُوا لِيَسْتَيْقِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَيَزْدَادَ الَّذِينَ آمَنُوا إِيمَانًا

‘আমি জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ফেরেশতাকেই রেখেছি। আমি কাফেরদেরকে পরীক্ষা করার জন্যই তাদের এই সংখ্যা নির্ধারণ করেছি, যাতে কিতাবধারীরা দৃঢ় বিশ্বাসী হয় এবং মুমিনের ঈমান বৃদ্ধি পায়।’[8]

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেনঃ

وَإِذَا مَا أُنزِلَتْ سُورَةٌ فَمِنْهُم مَّن يَقُولُ أَيُّكُمْ زَادَتْهُ هَٰذِهِ إِيمَانًا ۚ فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا فَزَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ
وَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ فَزَادَتْهُمْ رِجْسًا إِلَىٰ رِجْسِهِمْ وَمَاتُوا وَهُمْ كَافِرُونَ

‘আর যখন কোনো সুরা অবতীর্ণ হয়, তখন তাদের কেউ কেউ বলে, এ সুরা তোমাদের মধ্যে কার ঈমান কতটা বৃদ্ধি করল? তবে যারা ঈমানদার, এ সুরা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়েছে। বস্তুতঃ যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে এটি তাদের অন্তরে কলুষের সাথে আরো কলুষ বৃদ্ধি করেছে এবং তারা কাফের অবস্থায়ই মৃত্যু বরন করলো।’[9]

… সুতরাং, ঈমান বাড়ে এবং কমে।”[10]

তথ্যসূত্র:
[1] . ইবনু ফারিস, আহমদ, মু’জামু মাকায়িসিল লুগাহ ১/১৩৩
[2] . সুরা মায়িদা, আয়াতঃ ৫
[3]. সুরা আনফাল, আয়াতঃ ২
[4] . সহীহ বুখারী, ১/২৭
[5] . ইবন তাইমিয়্যাহ, আকীদাহ আল-ওয়াসিতিয়া, পৃঃ ৬৫
[6] . ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ইসলামী আকীদা, পৃঃ ২৫-২৬
[7] . ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ইসলামী আকীদা, পৃঃ ২৫
[8] . সুরা মুদ্দাসসির, আয়াতঃ ৩১
[9] . সুরা তাওবা, আয়াতঃ ১২৪-১২৫
[10] . ইবন উসাইমীন, ফাতওয়া আরকানুল ইসলাম, পৃঃ ৫৩-৫৪