ইসলামে সাময়িক বিবাহ করার বিধান

ইসলামে সাময়িক বিবাহ করার বিধান।
***************************************
ইসলামের সাময়িক বিবাহের কোনো বিধান আছে কি? আমার একজন বন্ধু অধ্যাপক আবুল জুরজির একটি কিতাব পড়ে, সে খুব প্রভাবিত হয়। তাতে বলা হয়, বিবাহিত হওয়া স্বত্বেও উভয়ের সম্মতিতে সাময়িক বিবাহ করাতে কোনো ক্ষতি নেই। একে ইসলামে নিকাহে মুয়াক্কাত বলে। যখন তোমার নিকট কাউকে ভালো লাগবে তখন তুমি অল্প সময়ের জন্য তাকে বিবাহ করে নিবে। নিকাহে মুত‘আ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিস্তারিত জানতে চাই। কোনো মাযহাবে এ ধরনের বিবাহ করার অনুমতি আছে কি?

উত্তর:

আলহামদুল লিল্লাহ

কোনো মহিলাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত টাকার বিনিময়ে বিবাহ করাকে ‘নিকাহে মুত‘আ’ অথবা ‘সাময়িক বিবাহ’ বলা হয় ।

বিবাহের উদ্দেশ্য হল, সম্পর্ক বজায় রাখা ও স্থায়ী করা। সাময়িক বিবাহ বা নিকাহে মুত‘আ বিবাহের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। এ ধরনের সাময়িক বিবাহ বা নিকাহে মুত‘আ ইসলামের প্রথম যুগে বৈধ ছিল। অতঃপর তা রহিত হয়ে যায়। এখন এ ধরনের বিবাহ কিয়ামত পর্যন্তের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। এ ধরনের কোনো বিবাহের বিধান ইসলামে বর্তমানে অবশিষ্ট নেই।

আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«أن رسول الله صلى الله وسلم نهى عن نكاح المتعة وعن لحوم الحمر الأهلية زمن خيبر».

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবারের বৎসর নিকাহে মুত‘আ ও গৃহপালিত গাধার গোশত খাওয়া থেকে নিষেধ করেছেন”। অপর বর্ণনায় আছে,

«نهى عن متعة النساء يوم خيبر وعن لحوم الحمر الإنسية».

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবারের দিন নারীদের সাথে মুত‘আ ও গৃহপালিত গাধার গোশত খাওয়াকে নিষেধ করেছেন”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৯৭৯, সহীহ মুসলিম হাদীস নং ১৪০৭)

রবী ইবন সাবুরা আল-জুহানী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তার পিতা তাকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলেন। তখন তিনি বলেন,

«يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنِّي قَدْ كُنْتُ أَذِنْتُ لَكُمْ فِي الِاسْتِمْتَاعِ مِنَ النِّسَاءِ، وَإِنَّ اللهَ قَدْ حَرَّمَ ذَلِكَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ، فَمَنْ كَانَ عِنْدَهُ مِنْهُنَّ شَيْءٌ فَلْيُخَلِّ سَبِيلَهُ، وَلَا تَأْخُذُوا مِمَّا آتَيْتُمُوهُنَّ شَيْئًا».

“হে মানবসকল! আমি তোমাদের মুত‘আর অনুমতি দিয়েছিলাম। আল্লাহ কিয়ামত দিবস পর্যন্ত তা নিষিদ্ধ করেছেন। তোমাদের কারো নিকট যদি তাদের কিছু থেকে থাকে তবে তোমরা তাদের মুক্তি দিয়ে দাও। তোমরা তাদের যা দিয়েছে তা আর ফেরত নিবে না”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৪০৬)

বিবাহকে আল্লাহ তা‘আলা তার নিদর্শন বানিয়েছেন। এতে রয়েছে মানুষের চিন্তার খোরাক। আল্লাহ তা‘আলা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মহব্বত ও অনুগ্রহ সৃষ্টি করেছেন আর স্ত্রীকে স্বামীর জন্য প্রশান্তিস্থল বানিয়েছেন। প্রজননের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন এবং নারীদের উত্তরাধিকারী করেছেন। এগুলো সবই উল্লিখিত নিষিদ্ধ বিবাহের মধ্যে অনুপস্থিত।

যারা এ ধরনের বিবাহ বৈধ বলে, তাদের মতে মুত‘আকৃত নারী তাদের স্ত্রীও নয় আবার ক্রিতদাসীও নয়। অথচ আল্লাহ তা‌‘আলা বলেন,

﴿وَٱلَّذِينَ هُمۡ لِفُرُوجِهِمۡ حَٰفِظُونَ ٥ إِلَّا عَلَىٰٓ أَزۡوَٰجِهِمۡ أَوۡ مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُهُمۡ فَإِنَّهُمۡ غَيۡرُ مَلُومِينَ ٦﴾ [المؤمنون : ٥، ٦]

“আর যারা তাদের নিজদের লজ্জাস্থানের হিফাযতকারী। তবে তাদের স্ত্রী ও তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে তারা ছাড়া। নিশ্চয় এতে তারা নিন্দিত হবে না। [সূরা আল-মুমিনূন, আয়াত নং ৫, ৬]

(বিরুদ্ধবাদীদের মত খণ্ডন)

শিয়ারা তাদের মতের পক্ষে কিছু দলীল দেন, যা দলীল হওয়ার যোগ্য নয়। যেমন-

আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

﴿فَمَا ٱسۡتَمۡتَعۡتُم بِهِۦ مِنۡهُنَّ فَ‍َٔاتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةٗۚ ٢٤﴾ [النساء : ٢٤]

“সুতরাং তাদের মধ্যে তোমরা যাদেরকে ভোগ করেছ তাদেরকে তাদের নির্ধারিত মাহর দিয়ে দাও”।

তারা বলে এ আয়াতের মধ্যে মুত‘আ হালাল হওয়ার দলীল রয়েছে। কারণ, আল্লাহ তা‘আলার বাণী أجورهن প্রমাণ করে استمتعتمদ্বারা উদ্দেশ্য মুত‘আ।

এর জাওয়াব: পূর্বের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা পুরুষের জন্য যেসব নারীদের বিবাহ করা নিষিদ্ধ হয়েছে তাদের আলোচনা করেছেন। তারপর এ আয়াতে যাদের বিবাহ করা যাবে তাদের আলোচনা করেছেন এবং বিবাহিতাকে তার মাহর আদায় করার নির্দেশ দেন। আর বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর উপভোগ ও পরিতৃপ্তিকে এখানে استمتاع শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করেছেন। এ ধরনের দৃষ্টান্ত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসেও এসেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«المرأة كالضِّلَع إن أقمتَها كسرتَها ، وإن استمتعتَ بها استمتعتَ بها وفيها عوج».

“নারীরা পাঁজরের বাঁকা হাড়ের মতো। যদি তাকে তুমি সোজা করতে যাও তবে তাকে তুমি ভেঙ্গে ফেলবে। আর যদি তাকে তুমি উপভোগ কর, তবে তুমি বাঁকা অবস্থায় তাকে উপভোগ করবে”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৮৮৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৪৬৮)

আর এখানে মাহরের ব্যাখ্যাটি বিনিময় দ্বারা করা হয়েছে। এখানে বিনিময় দ্বারা উদ্দেশ্য মাল নয় যা মুত‘আর চুক্তিতে নারীকে দেওয়া হয়। কুরআনের অন্য জায়গায় মাহরকে ‘আজর’ বলে নাম রাখা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ إِنَّآ أَحۡلَلۡنَا لَكَ أَزۡوَٰجَكَ ٱلَّٰتِيٓ ءَاتَيۡتَ أُجُورَهُنَّ﴾ [الاحزاب: ٥٠]

“হে নবী, নিশ্চয় আমরা আপনার জন্য বৈধ করে দিয়েছি আপনার স্ত্রীদেরকে যাদেরকে আপনি ‘আজর’ তথা মাহর প্রদান করেছেন।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫০]

সুতরাং এ কথা স্পষ্ট হল, কুরআনের আয়াতে এমন কোনো দলীল নেই যাতে প্রমাণ হয় যে, মুত‘আ বিবাহ হালাল।

তারপরও যদি আমরা তর্কের খাতিরে এ কথা মেনে নিই যে, আয়াত দ্বারা মুত‘আ বিবাহ বুঝানো হয়েছে, তাহলেও আমরা বলবো আয়াতটির বিধান রহিত। সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, নিকাহে মুত‘আ কিয়ামতের দিন পর্যন্ত নিষিদ্ধ।

কোনো কোনো সাহাবী বিশেষ করে ইবন ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে নিকাহে মুত‘আ বৈধ হওয়ার যে বর্ণনা পাওয়া যায় এর উত্তর হলো,

প্রথমত: এটি প্রমাণ করে যে, শিয়ারা তাদের প্রবৃত্তির অনুসারী। কারণ, তারা রাসূলের সাহাবীদের কাফির বলে, তারপর তারা এ বিষয়ে এবং অন্য যে কোনো বিষয়ে তাদের আমল দ্বারা তাদের মতের পক্ষে দলীল পেশ করে।

দ্বিতীয়ত: যে-সব সাহাবী থেকে মুত‘আ বৈধ হওয়ার বর্ণনা এসেছে, তারা ঐসব সাহাবী যাদের নিকট উক্ত বিবাহ হারাম হওয়ার দলীল পৌঁছে নি। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে সাহাবীরা বিশেষ করে আলী ও যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা নিকাহে মুত‘আকে বৈধ বলার সমুচিত জাওয়াব দিয়েছেন।

আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি ইবন আব্বাসকে মুত‘আর বিষয়ে নমনীয় বলে জানতে পেরে বলেন,

«مهلا يا ابن عباس فإن رسول الله صلى الله عليه وسلم نهى عنها يوم خيبر وعن لحوم الحمر الإنسية» .

“হে ইবন আব্বাস মুত‘আর বিষয়ে সাবধান। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবারের যুদ্ধে মুত‘আকে নিষেধ করেছেন এবং পালিত গাধার গোশত খেতে নিষেধ করেছেন”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৪০) বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন- (ইসলাম কিউএ) প্রশ্ন উত্তর: ১৩৭৩, ২৩৭৭, ৬৫৯৫

আল্লাহই ভালো জানেন।
———————————————-
শাইখ সালেহ আল-মুনাজ্জেদ
অনুবাদক: জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া।